রাজনৈতিক সংস্কৃতি
====ড. মুসলিমা জাহান====
রাজনীতি হচ্ছে মানুষ ও পৃথিবীর জন্য নৈতিকতা ও মূল্যবোধ গঠনের মন্ত্র যা একটি জাতিকে কেবল সম্পদে নয়, আচরণ ও মননশীলতায়ও সমৃদ্ধ করে। দীর্ঘদিন ধরে তার একটা ধারা যখন চলতে থাকে সেটা তৈরি করে রাজনৈতিক সংস্কৃতি।
সংস্কৃতি নিজে থেকে বদলায়। তবে কেউ জোর করে বদলাতে গেলে বাধাপ্রাপ্ত হবেই-সেটাও সংস্কৃতির অংশ। আমাদের দেশের রাজনীতিকে যারা পঁচা, পরিবারতান্ত্রিক, ব্যবসায়ভিত্তিক, মূর্খ, তেলবাজ, দূর্নীতিবাজ, স্বার্থপর এবং নষ্ট বলছেন তাদের জানা উচিত যে এই সংস্কৃতি একদিনে তৈরি হয় নাই। ঠিক তেমনি এটাকে যোগ্যতা ও জ্ঞানভিত্তিক, জনকল্যাণমূলক, সুশিক্ষিত ও সুশীল, আইন, বিচার ও সমাজ উন্নয়নমূলক, জীবনোন্নয়ন ও অর্থনৈতিক অগ্রতির নিয়ামক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে সময় যেমন লাগবে তেমনি প্রয়োজন হবে শিক্ষিত ও সচেতন সমাজের সক্রিয় অংশগ্রহন। শুধু সমালোচনার জন্য সমালোচনা নয়, বরং বাস্তবভিত্তিক পরিকল্পনা নিয়ে মানুষের জন্য কাজ শুরু করতে হবে।
জনপ্রতিনিধিরা আমাদের আমানতদার। আমাদের দেশের ব্যবস্থাপক। তাদের মূর্খতা, অব্যবস্থাপনা, লোভ, হিংসা এবং দূর্নীতির জন্য তারা একা দায়ি-কথাটা সত্যি নয়। আমরা দায়িত্ব নিইনি। অবহেলা করেছি। ভেবেছি সরকার চালানো আমাদের কাজ নয়। দিনের পর দিন, যুগের পর যুগ আমরা শিক্ষিতরা মানুষের জন্য কাজ না করে একটা চাকরী আর সংসার চালানোর উপায় নিয়ে ব্যস্ত থাকছি। সরকারকে অবহেলা করে সরকারী চাকরীর জন্য প্রতিনিধিদের সংসারের সরন্জামও সরবরাহ করেছি। তাতে সমাজের কী হচ্ছে জানার চেষ্টা করি না। সমাজে কিভাবে দূর্নীতির সংস্কৃতি তৈরি হয়েছে খেয়াল করিনি। দেশ কিভাবে রসাতলে গেল তার উদ্ধারের উপায় নিয়ে ভাবিনি। আমরা কেবল অপেক্ষা করছি এই ব্যর্থ প্রতিনিধিরা আমাদের জন্য কী আয়োজন করে তা দেখার জন্য। যদি তা আমাদের মনো:পুত না হয় আমরা চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে আক্ষেপ করি: রাজনীতি দেশটাকে একেবারে রসাতলে নিয়ে গেল।
আপাত:দৃষ্টিতে জনপ্রতিনিধিদের আমরা ঘৃণা করি। কাজ শেষ হয়ে গেলে গালি দিই-পুরুষ প্রতিনিধি হলে শালা আর মহিলা প্রতিনিধি হলে মাগী বলি। অথচ সুপার মার্কেট, শপিং মল, স্কুল কিংবা স্কুলের শাখা, নবীনবরণ কিংবা বিদায়-অনুষ্ঠান, দালানের ছাদ ঢালাই কিংবা কলাগাছ রোপনের জন্য আমরা জনপ্রতিনিধিদের শরণাপন্ন হই। তাদেরকে ডেকে এনে মাঝের আসন অলংকৃত করতে দিই। তাদের সাথে ক্যামেরা আসে, মিডিয়া আসে, পয়সাও আসে। সকল সংস্থাগুলো এভাবেই রাজনৈতিক প্রতিনিধিদের একে অপরের পরিপূরক হিসেবে কাজ করে। যেগুলেো ক্যামেরায় আসে সেগুলোর জন্য জনতা গালি দেয় আর যেগুলো মিটিংরুমে চলে সেগুলোর জন্য মেহমানদাররা গালি দেয়-চোর, বদমাশ, ভন্ড-নানা ধরনের গালি। ভালোর জন্য না মন্দের জন্য সেটা সাধারন মানুষ ঠিক বুঝতে পারে না।
জনপ্রতিনিধিরা জনতার বিপদে এগিয়ে আসে। চাকরী দেয়া থেকে শুরু করে চাল-ডাল পর্যন্ত-জনগণ হাত পেতে তা নেয়। সেগুলো কিছু ট্যাক্সের টাকায়, কিছু হয়ত কালো টাকার, কিছু হয়ত যাকাত ফিতরার অংশ। এই সংস্কৃতিই রাজনীতির সবচেয়ে বড় জুয়া। রাজনীতিকরা জনগণকে কখনোই তাদের এই অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য বাজি ধরেন না। যোগ্যতায় মানুষ তার জায়গা করে নেবে সে সুযোগ ও রাখেন না। কিন্ডারগার্টেনে বাচ্চা ভর্তি থেকে শুরু করে জনপ্রশাসনের বদলিতেও নাক এবং হাত দুটোই গলানোর ক্ষমতা রাখেন এবং ব্যবহার করেন তারা। দানের হাত তাদের সবসময় উপরেই থাকে। ভয় যদি জনতার হাত উপরে উঠে যায় কখনো-জনতা তখন নিজের যোগ্যতার সাথে সাথে আত্মবিশ্বাসও ফিরে পেতে পারে। তাই ত্রাণ দিয়ে তাদের কিনতে হয়। তারা যতদিন হাত পেতে দান নেবে ততদিন জনপ্রতিনিধিরা নিশ্চিত থাকবে তাদের সমর্থন আর দুয়ারে দাঁড়ানো লোক সমাগমের ব্যাপারে। জনতা যে তাদের ব্যক্তিত্বকে বিক্রি করে দান নেয় সেটা তাদের বোঝানোর মত শিক্ষার ব্যবস্থাও রাখা হয় না। সেখানে ছাত্ররা শেখে- যোগ্যতা নয়, অনুসরণই বড় কথা। এই সংস্কৃতি থেকে বের হবার জন্য কেউ প্রস্তুত নয়, কেউ আগ্রহী নয়। জনতার হাত পাতা বন্ধ করতে তাদের পায়ের তলার মাটি শক্ত করার মত শক্তি নেতারা অর্জন করে উঠতে পারেন না। কারন তাতে ভাংগবে অনেক কিছু, কিন্তু গড়বে আরো বড় কিছু।
ক্ষণিকের লাভের জন্য জনতা আর জনপ্রতিনিধি উভয়েই মশগুল। দেশ, মানুষ আর নতুন প্রজন্ম-তা কেবল ব্যবসা-ভাবনার। আর সর্বোচ্চ প্রতিনিধিদের যে সংসদ সেটা তখন ব্যবসায়ীদের ক্লাব। আর এই ক্লাবের সদস্যদের ঘুরে ফিরে একই ব্যবসা-গার্মেন্টস্, ব্যাংক-ইন্সুরেন্স, মিডিয়া, রিয়েল এস্টেট এবং শিক্ষা ও স্বাস্থ্য। খোদ রাষ্ট্রপতিও ব্যবসায়ী সাংসদ নিয়ে খেদ প্রকাশ করেছেন। কিন্তু ওই যে আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতি-আমরা বের হতে পারছি না।
কুর্ট লীউইট-এর চেন্জ ম্যানেজমেন্ট মডেল আছে-বদল ব্যবস্থাপনা। প্রথমে আনফ্রিজ (ঠান্ডা থেকে স্বাভাবিক ; স্থিতাবস্থা) করে নিয়ে বিষয়টি বদলে দিতে হবে। তারপর রিফ্রিজ করতে হবে। সহজ কথায় আমাদের বিখ্যাত অভিনেতা হুমায়ুন ফরিদীর (আশা করি উৎস ঠিক) কথায় আসি-উঠে দাঁড়াতে হলে হাত লাগে আর ঘুরে দাঁড়াতে লাগে একটা আঘাত। করোনা যে আঘাত করেছে তাতে এখন স্থিতাবস্থা বিরাজ করছে। এখন বদলের সময়। আসুন, বসে না থেকে, কেবল রাজনীতি আর রাজনীতিবিদদের সমালোচনা না করে আমরা নিজেরাও দেশের কাজে লেগে পড়ি।
বাংলাদেশের আমানতদার আর ব্যবস্থাপকরা হোক সাহসী, সংগ্রামী, শিক্ষিত, জ্ঞানী আর দেশপ্রেমিক। যে দেশে পদ্মা, মেঘনা, যমুনার মত বড় বড় নদী আছে,দেশের আয়তনের চেয়ে দেড়গুণ বড় সমুদ্রসীমা আছে, যে দেশে পরিশ্রম করার মত কোটি কোটি মানুষ আছে সে দেশের ভাগ্য বদলাতে দরকার জায়গামত যোগ্য লোক, কৌশলগত পরিকল্পনা আর তার বাস্তবায়ন। সমস্ত অপসংস্কৃতি এমনিতেই উবে যাবে।
বাংলাদেশ নামক দেশের ব্র্যান্ডিং কেবল সময়ের ব্যাপার।।
লেখকঃ ড. মুসলিমা জাহান, সহকারী অধ্যাপক ও সাবেক পরিচালক ,এমবিএ ও ইএমবিএ প্রোগ্রাম, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়।
Leave a Reply