“আমরা কি আত্মহত্যা নিয়ে যথেষ্ট কথা বলছি?”
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) জরিপে দেখা যায় গ্রিনল্যান্ডে আত্মহত্যার হার সবচেয়ে বেশি।পৃথিবীতে বছরে আট লাখ মানুষ আত্মহত্যা করে থাকেন। প্রতি ৪০ সেকেন্ডে ১ জন! বাংলাদেশে বছরে গড়ে ১০ হাজার জন আত্মহত্যা করেন। করোনাকালীন সময়ে গত এক বছরে সারা দেশে আত্মহত্যা করেছে ১৪ হাজার ৪৩৬ জন নারী-পুরুষ। এর মধ্যে নারীর আত্মহত্যার ঘটনা ৮ হাজার ২২৮টি এবং পুরুষের আত্মহত্যার ঘটনা ৬ হাজার ২০৮টি। অপরদিকে পাশ্চাত্যে মধ্য বা শেষ বয়সী মানুষেরা একাকিত্বে ভোগেন, যার কারণে সেখানে ৪০ থেকে ৫০ বছর বয়সী একাকী পুরুষদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা বেশি। প্রায় ১৫ থেকে ২০ গুণ মানুষ আত্মহত্যার চেষ্টা চালিয়ে ব্যর্থ হয়। আত্মহত্যার প্রবণতা রোধে জনসচেতনতা বাড়াতে বিশ্ব সাস্থ্য সংস্থা ( WHO)মতানুযায়ী ২০০৩ সাল থেকে প্রতি বছর বিশ্বব্যাপী ১০’ই সেপ্টেম্বর কে “বিশ্ব আত্মহত্যা প্রতিরোধ দিবস” হিসেবে পালন করা হয়ে আসছে।বেশিভাগ ক্ষেত্রে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে আত্মহনেন প্রবণতা বেশি তবে এক্ষেত্রে নারীদের সংখ্যা বেশি।বাংলাদেশে নারীদের ক্ষেত্রে এ সংখ্যাটা ৫৭ শতাংশ এবং পুরুষের ক্ষেত্রে ৪৩ শতাংশ।বিশেষজ্ঞদের মতে,আত্মহত্যার মত ঘৃণিত অপরাধ করার সময় তারা নানারকম মানসিক ব্যধিতে বা বিষন্নতা জনিত অসুখে ভোগেন।
স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ আজহারুল ইসলাম বলেন- বিষণ্ণতা থেকেই মূলত মানুষ আত্মহত্যা করে। দুশ্চিন্তা, উদ্বেগ থেকে মানুষ নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না; তখন ঠুনকো কোনো কারণে নিজেদেরকে ধরে রাখতে পারে নাই তাই এমন পরিণতির উদ্রেক হয়।তাছাড়াও সিজোফ্রেনিয়া, পার্সোনালিটি ডিসঅর্ডার, এন্টি সোশ্যাল ডিসঅর্ডার,বাইপোলার ডিপ্রেসিভ ডিসঅর্ডার, বর্ডারলাইন ডিসঅর্ডার, এক্সট্রা ম্যারিটাল অ্যাফেয়ার্স,ডিভোর্স,যৌন হয়রানি, ব্যবসায়িক ক্ষতি, প্রেমে ব্যর্থতা,বৈষম্য বঞ্চনা, বেকারত্ব এবং অন্যান্য।
অন্যদিকে আমাদের দেশে প্রতিবছর বিভিন্ন পাবলিক পরীক্ষার পর, বিভিন্ন গণমাধ্যমে খবর আসে আত্মহত্যার। কারণ, ফলাফল খারাপ, অকৃতকার্য হওয়া নয়তো জিপিএ ৫ পায়নি।
রেনেসাঁর সময় থেকে আত্মহত্যার প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি ধীরে ধীরে পরিবর্তন শুরু হয়েছিল। জন ডন এর কাজ ‘বাইথানটোস’ আত্মহত্যার প্রথম আধুনিক সুরক্ষার মধ্যে একটি ছিল, যিশু, শিমসন এবং শুলের মতো বাইবেলের পরিচয়ের আচার থেকে সাক্ষী এবং নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে আত্মহত্যার অনুমোদনের জন্য যুক্তি ও প্রকৃতির ভিত্তিতে আর্গুমেন্ট উপস্থাপন করেছিল ।
রাজনীতিবিদ রবার্ট বাড ডয়ারের মৃত্যুই সম্ভবত পৃথিবীর সবচেয়ে আলোচিত আত্মহত্যা। তার আত্মহননের দৃশ্য ক্যামেরাবন্দী হয় এবং পরবর্তীতে তা প্রচারিত হয়।সে আমেরিকার পেনসিলভানিয়ার সিনেটের ১৯৮০ সালে ট্রেজারি ডিপার্টমেন্টের প্রধান নিবার্চিত হয়,এসময় তার বিরুদ্ধে ঘুষের অভিযোগ দেওয়া হয়, তদন্তে তাঁর নাম উঠে আসে, ৫৫ বছরের কারাদন্ড সহ তিন লাখ ডলারের জরিমানা হয়। তবুও সে নিজেকে নির্দোষ বলে দাবি করেন এবং প্রেস কনফারেন্স সকলের সামনে আত্মহত্যা করেন,তাঁর মৃত্যুর দুই দশক পরে প্রমাণিত হয় যে তিনি নিরপরাধ ছিলেন।
“There’s a time for daring and there’s a time for caution and a wise man understands which is called for “- Dead poets society
এই বিখ্যাত মুভিতে আইকনিক চরিত্রে কাজ করেছিলেন বিখ্যাত কমেডিয়ান রবিন উইলিয়ামস।যে কিনা আত্মহননের পথ বেছে নিয়েছিলেন।
করোনাকালীন সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাসে এক বাড়ি থেকে ছয়জন বাংলাদেশির লাশ উদ্ধার করেন পুলিশ, যাদের মধ্যে পাঁচজনই একই পরিবারের সদস্য। ‘বিষণ্নতা থেকে’ পরিবারটির দুই তরুণ সহোদর তাদের মা-বাবা, নানী ও একমাত্র বোনকে হত্যার পর নিজেরাও আত্মহত্যা করেছে বলে পুলিশের ধারণা করছে।
আত্মহত্যা একটি প্রতিরোধযোগ্য বিষয়; সঠিক সময়ে উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারলে অবশ্যই আত্মহত্যা ঠেকানো যায়।
আত্মহত্যাকে নিরুৎসাহিত করার জন্য সরকারসহ বিভিন্ন সেচ্ছাসেবী সংগঠন এগিয়ে এসেছে। আত্মহত্যা প্রতিরোধ করতে হলে সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে, শিশুদের বিকাশের সময় তাদের এমনভাবে গড়ে তুলতে হবে, যাতে তারা সফলতার মতো ব্যর্থতাকে মেনে নিতে কুন্ঠাবোধ না করে। আত্মহত্যার উপকরণ, যেমন ঘুমের ওষুধ, কীটনাশকের সহজলভ্যতা কমাতে হবে, প্রেসক্রিপশন ছাড়া ঘুমের ওষুধ বিক্রি বন্ধ করতে হবে। যেকোনো ধরনের মানসিক সমস্যা বা আত্মহত্যার ইঙ্গিত পেলে দ্রুত মনোরোগ বিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন হতে হবে। মানসিক রোগের দ্রুত শনাক্ত করা ও সুচিকিৎসার ব্যবস্থা করেত হবে, পারিবারিক বন্ধনগুলো দৃঢ় করতে হবে,দূরত্ব কমিয়ে আনতে হবে। এ জন্য সবাইকে যার যার ক্ষেত্র থেকে একযোগে কাজ করে যেতে হবে পরিবারে প্রত্যেকের সঙ্গে গুণগত সময় কাটাতে হবে,পরিবারকেও সহমর্মিতার হাত বাড়িয়ে দিতে হবে। বাঁকা কথা, নেতিবাচক মন্তব্য, মুখ সরিয়ে নিলে তার কেউ নেই—এ চিন্তা যেন মনের মধ্যে গেঁথে না বসে। আত্মহত্যার পথ থেকে সরিয়ে আনতে পাছে লোকে কিছু বলে, সামাজিক মর্যাদাহানি এ রকম পুরনো চিন্তা-চেতনা থেকে পরিবারের সদস্যদেরও বের হয়ে আসতে হবে।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা হল আত্মহত্যার সংবাদ পরিবেশনের সময় গণমাধ্যমগুলোকে সব সময় অনুমোদিত নির্দেশিকা মেনে চলতে হবে। প্রথাগত প্রচারমাধ্যমের পাশাপাশি বিকল্পধারার ইন্টারনেটভিত্তিক প্রচারমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগের সাইটগুলোর ব্যবহারকারীদেরও সতর্কতার সঙ্গে আত্মহত্যার বিষয় নিয়ে মন্তব্য ও ছবি পোস্ট করতে হবে। এখানেও কোনো আত্মহত্যার ঘটনাকে খুব মহৎ করে দেখানোর চেষ্টা করা যাবে না, যাতে করে দুর্বলচিত্তের মানুষরা আত্মহত্যায় প্রণোদিত না হয়। বিষয়টি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগের সাইটগুলোর কর্তৃপক্ষেরও নিজস্ব নীতিমালা থাকা প্রয়োজন। আত্মহত্যা প্রতিরোধে একটি সার্বক্ষণিক হটলাইন সার্বক্ষণিক চালু করতে হবে পাশাপাশি বিভিন্ন ওয়েবমিনারের ব্যবস্থা করতে হবে,ক্রাইসিস সেন্টার চালুসহ বিষাদগ্রস্তদের কাউন্সিলিংয়ে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। ‘কান পেতে রই’ এমনই একটি হটলাইন যেখানে বিষাদগ্রস্তদের সঙ্গে কথা বলে নানারকম সমস্যার সমাধান দেওয়া হয়। সচেতনতা বাড়াতে
প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নিতে হলে প্রথমে বৃদ্ধি করতে হবে সচেতনতা, ভূক্তভোগীকে নিঃসঙ্গতা কাটাতে সাহায্য করতে হবে,ডিপ্রেশন যে অস্বাভাবিক কিছু নয় সেটা বুঝতে দিতে হবে৷ ট্রামে বাসে ও বিভিন্ন স্থানে প্ল্যাকার্ড লাগিয়ে মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করা যেতে পারে৷ বিশেষ করে চিকিৎসকদের সচেতনতা বাড়াতে হবে৷ লক্ষ্য করা গিয়েছে আত্মহত্যার আগে অনেকে সাহায্যের জন্য ডাক্তারের কাছে যান৷ কিন্তু তাদের মানসিক যন্ত্রণা সঠিকভাবে বুঝতে পারেন না অনেক চিকিৎসক- বলেন ডাব্লিউএইচও-এর মাথিস মুইয়েন৷
উপরন্ত দেখা গেছে, একবার সফল না হলে অনেকে আর আত্মহননের চেষ্টা করেন না৷ ধাক্কাটা সামলে ওঠেন৷
অন্যদিকে মিডিয়ারও এক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রয়েছে৷ তাদের এমনভাবে খবর প্রচার করা উচিত নয়, যাতে ৷সকল প্রজন্মের মাঝে ছড়িয়ে দিতে হবে মানবিক মূল্যবোধ ; আমাদের সকলের সম্মিলিত প্রয়াসেই আমরা তথাকথিত এই সামাজিক ব্যধিকে উপড়ে ফেলতে পারব।আত্মহত্যা আইনের চোখেও অপরাধ;আইনে অপরকে হত্যা করা এবং নিজেকে হত্যা করা উভয়ই শাস্তিযোগ্য অপরাধ।দন্ডবিধি ৩০৯ অনুযায়ী যে ব্যক্তি আত্মহননের চেষ্টা করবে কিংবা এরূপ আচরণ গ্রহণ করবেন তাকে একবছরের সশ্রম কারাদন্ড ভোগ করতে হবে।সকল পর্যায়ের ব্যক্তিবর্গের অংশগ্রহণ এক্ষেত্রে প্রয়োজন,সকলে মিলে সচেতনতা তৈরি করতে হবে,সবর্দা আত্মহননের চিন্তাকে নিরুৎসাহিত করতে হবে,ধর্মীয় অনুশাসন পালন করতে হবে।সকল ধর্মেই আত্মহত্যা কে ঘৃণিত অপরাধ বলে বিবেচনায় রেখেছে। করোনাকালীন সময়েআঁচল ফাউন্ডেশন বৃহৎ ভূমিকা রাখে।
আঁচল ফাউন্ডেশনের যাত্রা ২০১৯ সালের ২৫ এপ্রিল। তরুণদের এ সংগঠনটি মূলত শিক্ষার্থীদের দক্ষতা ও মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়গুলো নিয়ে কাজ করে থাকে। প্রশিক্ষণ, কর্মশালার মাধ্যমে তারা করোনাকালেও শিক্ষার্থীদের নানা কাউন্সিলিং দিয়েছে।
নিজেকে ভালবাসতে হবে,জীবনকে আনন্দঘন করে তুলতে হবে।সুখ-দুঃখ মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ,তাই জীবন যুদ্ধে পরাজয়ের গ্লানিকে বয়ে নিয়েও সংগ্রামে অবরুদ্ধ থেকে প্রাণপণে চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে।ঘাত-প্রতিঘাতের সম্মুখীন হয়েও ধৈর্য ধরে নিজের গন্তব্যে পৌঁছে যেতে হবে।
আমরা কি আত্মহত্যা নিয়ে যথেষ্ট কথা বলছি? সচেতন হয়েছি? কেন মানুষ নিজের জীবন দিয়ে দেয়? কেন মানুষ এত সুন্দর পৃথিবীতে আর বেঁচে থাকতে চায় না?মুঠোভরা প্রশ্নের সম্মুখে কদাচিৎ দাঁড়িয়ে আছি আমরা। তাও একরাশ আত্মবিশ্বাস নিয়ে এই লড়াইয়ে বহ্নিশিখার ন্যায় প্রজ্জ্বলিত হয়ে আগামীর সম্ভাবনাময় রাষ্ট্র গঠনে উদ্বুদ্ধ হতে হবে এবং জনসচেতনতা সৃষ্টি করতো হবে।
“দেখি শুনি স্মৃতিতে জমা রাখি আগামী প্রজন্মের জন্য, বিশ্বাস রাখি শুকনো ডালের ঘর্ষণে আগুন জ্বলবেই।”
লেখিকাঃ শ্রেয়সী সিকদার,
গণমাধ্যমকর্মী
Leave a Reply