এক স্বাধীন স্বপ্নদ্রষ্টা ও রাজনীতির কবি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
১৯২০-সালের ১৭-ই মার্চে গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় জন্ম নিয়েছিলো এক উদার মনের অধিকারী ,পরবর্তীকালে সাহস কর্ম,নেতৃত্ব গুণ,ও বিশ্বাসে যিনি হয়ে উঠেছিলেন কালজয়ী পুরুষ। নাম তাঁর শেখ মুজিবুর রহমান,হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ সন্তান। ডাক নাম খোকা।সবার অতি আদরের নয়নের মণি খোকা।একজন স্বচ্ছল কৃষকের ঘরে জন্ম নেওয়া মুজিব বিরাট মাপের কোনো শিক্ষাগত অর্জন ছাড়াই লেখাপড়া শেষ করেন।
একজন গড়পড়তা বাঙালির তুলনায় লম্বা (তাঁর উচ্চতা ৫ ফুট ১১ ইঞ্চি), চুলে রুপালী আভা, পুরু গোঁফ এবং কালো গভীর চোখ ও গভীর চাহনীর অধিকারী মুজিব খুব সহজেই লাখো মানুষের হৃদয় আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছিলেন।বাংলাদেশের স্বাধীনতা যার হাত দিয়েই গড়ে উঠেছে।যাঁর দীপ্ত কন্ঠে উদ্দীপ্ত হয়ে সাধারণ মানুষ ও যুদ্ধে নেমেছে তিনিই হলো বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
কি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কি ভারতের কলকাতায় ;সমস্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই সময়ের সাথে সাথে তিনি একজন জনপ্রিয় ছাত্রনেতায় পরিণত হয়েছিলেন। মানুষের সাথে নিবিড়ভাবে মিশতে ও কথা বলতে পছন্দ করতেন। চলনে বলনে খেলাধুলায় তিনি সময়ের সাথে হয়ে উঠেছিলেন অসামান্য। কলকাতার ইসলামিক কলেজে যখন তিনি লিবারেল আর্টস ডিগ্রীর জন্য পড়াশোনা করতে গেলেন তখন সেখানকার মুসলিম লীগের কিছু জ্যেষ্ঠ নেতাকর্মীর নজরে আসেন। তাঁর রাজনৈতিক গুরু ছিলেন তখন এইচ এস সোহরাওয়ার্দী, যিনি ব্রিটিশরাজের অধীনে বাংলার প্রধানমন্ত্রী ছিলেন, পরবর্তীতে তিনি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে এক বছর দায়িত্ব ও পালন করেন। মুজিব আইন বিষয়েও পড়াশোনা করেন। কিন্তু সোহরাওয়ার্দীর রাজনৈতিক আদর্শ ভিন্ন হওয়ায় মুজিব তাঁর পদাঙ্ক অনুসরণ না করে সরাসরি নতুন পদক্ষেপের দিকে ঝুঁকে পড়েন। চল্লিশের দশকের শেষ দিকে তাঁরা দুজনেই অনুধাবন করতে শুরু করলেন যে, নব গঠিত পাকিস্তানের অন্যতম প্রধান প্রদেশ বাংলাকে নানা সুবিধা থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে। ১৯৪৯ সালে সোহরাওয়ার্দী সুসংগঠিত “বাংলার বাঙালিদের জন্য” আওয়ামী লীগ নামের নতুন রাজনৈতিক দল প্রতিষ্ঠা করেন। মুজিব রাজপথে নেমে গেলেন এবং অবৈধ হরতালের সাথে জড়িত থাকার অপরাধে তাকে দুইবার গ্রেফতার করে কারাগারে প্রেরণ করা হয়েছিলো।
জেল হতে বের হয়েই মুজিব যুক্ত হয়ে গেলেন আওয়ামী লীগে। বলিষ্ঠ কর্মকান্ডের জন্য একসময় সোহরাওয়ার্দীর ডান-হাতে পরিণত হলেন। কিন্তু অন্যান্য দলের সাথে জোট গঠন হওয়ায় তাঁর নেতৃত্ব দেবার সম্ভাবনাকে ধ্বংস করে দেয়া হলো। তবে ১৯৫৬ সালে মুজিব সাফল্যের সাথে পূর্ব-পাকিস্তানে নবগঠিত আওয়ামী লীগকে প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হন। সাত মাস কৃতিত্বের সাথে তিনি শিল্প ও বানিজ্য মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন।১৯৬৩ সালে সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুর পর মুজিব অনেকটা বিনা বাঁধায় তাঁর কিছু পুরানো আদর্শিক রীতিনীতিতে পরিবর্তন আনতে সক্ষম হন। তিনি আওয়ামী লীগকে পুনরুজ্জীবিত করেন। রাজনীতিতে যুক্ত করেন “স্বতস্ফুর্ততার” শৈলী এবং আভ্যন্তরীন নিজস্ব শাসন ব্যবস্থার দাবী করেন। পূর্ব পাকিস্তান স্বাধীন করার ষড়যন্ত্রের অভিযোগে ১৯৬৬ সালে আইয়ুব খান সরকার তাকে পুনরায় গ্রেফতার করে। পূর্ব-পাকিস্তানে তখন বিদ্রোহের আগুন জ্বলে উঠলো। ফলস্রুতিতে আইয়ুব খান পদত্যাগ করে মুজিবকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়েছিলো।তাই জনগণের চোখে মুজিব জাতির নায়ক হিসেবে আবির্ভূত হলেন।
তাঁর উদ্দীপ্ত ভাষণের মাধ্যমে জনগণকে আপ্লুত করার অসীম ক্ষমতা ছিল তাঁর। একজন কূটনৈতিক ও রাজনৈতিক গবেষকের মতে –“তুমি তাঁর সাথে একা আলাদাভাবে কথা বললেও তাই হবে এবং তিনি এমনভাবে কথা বলেন মনে হবে তিনি ৬০ হাজার মানুষের সামনে বক্তব্য দিচ্ছেন।সাম্যবাদীও সদা-প্রস্তুত এক পৌরুষ পুরুষ।
একাধারে উর্দু, বাংলা এবং ইংরেজী –৩-টি ভাষায়ই তিনি সমান পারদর্শী। মুজিবের মাঝে চিন্তাবিদ হবার ইচ্ছে ছিলো না, তিনি কোনো প্রকৌশলীও ছিলেন না,বরং তিনি ছিলেন রাজনীতির কবি। কিন্তু সচরাচর বাঙালিদের মতো কৌশলী ছিলেন না,তিনি ব্যাবসায়ী ও ছিলেন না,বরং কিছুটা চিন্তক, এবং সকল অঞ্চলের ভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শ ও সকলকে একত্রীকরনের জন্য তাঁর শক্তিশালী রাজনৈতিক আদর্শই সেই জন্য হয়তো খুবই দরকার ছিলো।আর তাই তাঁকে বলা হয় এক সত্য পুরুষ, রাজনীতির শিল্পী।বাংলার স্বাধীনতার কারিগর।
ব্রিটিশ সাংবাদিক ডেভিড ফ্রষ্ট ১৯৭২-সালে একটি গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষাৎকার নেবার সময় বঙ্গবন্ধুকে জিজ্ঞেস করেছিলেন,
আপনার শক্তি ও দূর্বলতার দুটি দিক সম্পর্কে বলুন,উত্তরে তিনি বলেছিলেন,শক্তির জায়গা হলো আমি আমার জনগণকে ভালোবাসি,আর দূর্বলতার জায়গা হলো আমি আমার জনগণ কে খুব বেশি ভালোবাসি!
একই বছরে স্বনামধন্য ব্রিটিশ সংবাদ মাধ্যম নিউজউইক বঙ্গবন্ধুকে “রাজনীতির কবি”
উপাধিতে ভূষিত করেন।
বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্ব,মানবদরদী মনোভাব
,মমত্ববোধ,সিদ্ধান্ত ও সিদ্ধান্তের প্রতি অবিচলতা বিশ্লেষণ করতে গিয়ে প্রথমেই মনে পড়ে কিউবার বিপ্লবী জননেতা “ফিদেল ক্যাষ্ট্রো’র করা সেই গবেষণাধর্মী মন্তব্য, “আমি হিমালয় দেখিনি,কিন্তু শেখ মুজিবুরকে দেখেছি”।বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ব্যক্তিত্বে,বিশ্বাসে ও সাহসীকতায় সত্যিই হিমালয়ের মতোই ছিলেন।তাঁর ব্যক্তিত্বের বিশালতায় সারাবিশ্ব মুগ্ধ ছিলো।
সর্বোপরী তিনি সমগ্র পৃথিবীর হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালী হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছেন সাধারণ মানুষের ভোটে।এই স্বীকৃতিও মানুষের ভালোবাসারই প্রতিফলন।এই রক্তঝরা মার্চে ও মুজিববর্ষে বাঙালী জাতির এই মহান নেতার জন্মতিথিতে
একটিই প্রার্থনা স্রষ্টা যেনো বাংলার মায়েরদের ঘরে ঘরে এমন দুঃসাহসী, মানবদরদী,বিপ্লবী সন্তান দান করেন।”
লেখকঃ জাফর আহমেদ শিমুল
Leave a Reply