বিগত কয়েক বছরে বাজারে কাঁচা চামড়া বিক্রি হচ্ছে নাম মাত্র মূল্যে, কোথাও অবিক্রিত থেকে যাচ্ছে। অসাধু ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেটের দরুণ চামড়ার সঠিক মূল্য পাচ্ছে না চামড়া বিক্রেতারা এবং সেই সাথে গরীব দুঃখীরাও কোরবানির চামড়ায় তাদের হক ন্যায্য টাকা বঞ্চিত হচ্ছেন। অসাধু ব্যবসায়ীদের এ সিন্ডিকেট রুখতে বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে চামড়াকে খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করা যেতে পারে।
সম্প্রতি বেশ কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেটেরিনারি বিভাগের ছাত্ররা ও ভেট সেক্টরের কিছু পরিচিত মুখ চামড়াকে খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করেছে। তাদের নিয়ে গত ২৭ জুলাই, মঙ্গলবার রাত ৯টায় এগ্রোভেট বায়ো সলিউশন ‘চামড়ার বিকল্প ব্যবহার: খাদ্য হিসেবে চামড়া’ শীর্ষক লাইভ প্রোগাম আয়োজন করে।
যেখানে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ডা. মো: নূরে আলম (ইউএলও, প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর)। চামড়া খাবার ইসলামি দিক নিয়ে আলোচনা করেন মাওলানা ডা. মো: শহিদুল ইসলাম আকন্দ, এম.এম(তাফসির), সিনিয়র সিএসও (নারিশ পোল্ট্রি এন্ড হ্যাচারী লিমিটেড), হাফেজ মুফতি শরীফুল্লাহ মোবারক (দাওয়াতে হাদিস, মুফতি, মোহাদ্দিস, মোফাসসির, আদিব) শায়খুল হাদিস, জামিয়া মাদানিয়া দারুল উলুম হোসাইনিয়া, কুলিয়ারচর, কিশোরগঞ্জ এবং ডাঃ মো. জিয়া উদ্দিন ইব্রাহিম, (এরিয়া এক্সিকিউটিভ, এসিআই গোদরেজ এগ্রোভেট লিঃ)।
খাদ্য হিসেবে চামড়া প্রক্রিয়াজাত করে নিজেদের অভিজ্ঞতা বিনিময় করেন মালিক মো: ওমর (এমডি, হোমল্যান্ড ডেইরি চট্টগ্রাম), বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেটেরিনারি বিভাগের শিক্ষার্থী ইউসুফ আলী, সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেটেরিনারি বিভাগের শিক্ষার্থী সাদ রাফি ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেটেরিনারি বিভাগের শিক্ষার্থী ফরিদুল ইসলাম।
মাওলানা ডা. মো: শহিদুল ইসলাম আকন্দ তার আলোচনায় বলেন, “জবাইকৃত হালাল পশুর চামড়া খাওয়ার ক্ষেত্রে ইসলামের কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। তিনি কুরআন ও হাদিস এর আলোকে চামড়া যে হারাম নয় তার পক্ষে যুক্তি, প্রমাণ দেন। তিনি বলেন, ইসলামি শরিয়ত এর মতে কোন জিনিস হারাম হতে হলে বস্তুটি ক্ষতিকর কিনা, অপবিত্র কিনা, খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করলে হারাম কাজে উদ্বুদ্ধ করে কিনা এই তিনটি বিষয় দেখতে হবে। সূরা মায়েদা এর তিন নম্বর আয়াতের উদ্ধৃতি দিয়ে তিনি বলেন মৃত প্রাণী, প্রবাহিত রক্ত এবং শূকরের মাংস আল্লাহ তাআলা কুরআনে নিষেধ করেছেন। চামড়া এসব বিষয় গুলোর মধ্যে পড়ে না।
এছাড়া তিনি বলেন, হাঁস মুরগির চামড়া খাওয়া নিয়ে তো কোন কথা হয়না। মূলত গরুর চামড়া খাওয়া আমাদের দেশে প্রচলিত নয়, এই ভুল ভাঙ্গাতে হবে। তিনি ইন্দোনেশিয়া মালয়েশিয়া নাইজেরিয়া সহ বিভিন্ন মুসলিম দেশে চামড়াকে সুস্বাদু খাবার হিসেবে খাওয়ার বিষয় গুলি তার বক্তব্যে তুলে ধরেন।” ডা. মো: জিয়া উদ্দিন ইব্রাহিমও তার সাথে একমত প্রকাশ করে বলেন, চামড়া ফেলে দেওয়া, পুঁতে ফেলা অপচয়ের শামিল। সাহাবিদেরও চামড়া খাওয়ার নজির আছে তাদের আলোচনায় ফুটে উঠে।
তারপর মূল প্রবন্ধ পেশ করেন ডা. নূরে আলম। তিনি ভেটেরিনারি সায়েন্স এর আলোকে চামড়া সম্পর্কিত বিষয়াদি বিশ্লেষণ করেন। তিনিই প্রথম চামড়ার বিকল্প ব্যবহার সম্পর্কে বলেন। তিনি যোগ করেন রাষ্টীয়ভাবে তা প্রতিষ্ঠা করার জন্য এগ্রোভেট বায়ো সলিউশন কাজ করছে। ডা. নূরে আলম প্রথমে তার অনুপ্রাণিত হওয়ার গল্প নিয়ে বলেন- “চামড়া নদীতে ফেলা হচ্ছে, গত বছর ১৫০০ চামড়া পদ্মায় ভাসিয়ে দেয়া হয়, চামড়া মাটিতে পুঁতে ফেলা হচ্ছে, ভাগাড় এ ফেলা হচ্ছে। মোটামুটি একটা ভালো মানের জুতা যেখানে ৩০০০ টাকা সেখানে চামড়া কোথাও কোথাও ১০০ টাকা বা তার থেকেও কম। যদি আমরা মার্কেটে ডিমান্ড করতে পারি তাহলে সার্থক। ডিমান্ড তৈরির জন্যই আমরা খাওয়ার চিন্তা করেছি। ইব্রাহিম ভাই, মালিক ওমর ভাই, আমি চামড়া খাওয়ার জন্য প্রসেসিং করেছি গতবছর।”
তিনি চামড়া সম্পর্কে আরো বলেন- “চামড়া হচ্ছে মেরুদণ্ডী প্রাণীদের বাইরের আবরণ, ভিতরের অঙ্গগুলো সেইভ করে। আর অমেরুদণ্ডী প্রাণীদের ক্ষেত্রে এক্সোস্কেলেটন। চামড়ার কাজ হচ্ছে ভিতরের অঙ্গগুলো প্রোটেকশন, রেগুলেশন এ সাহাযা, সেনসেশন সাহায্য করাসহ ভিটামিন ডি উৎপন্ন করা। স্কিন এর পার্ট যদি দেখি তাহলে ৩ টা পার্ট আছে-এপিডার্মিস, ডার্মিস, হাইপোডার্মিস যার উপাদান ক্যারাটিন, কোলাজেন, ২টাই আমিষ। উপরের স্টার্টাম কোরনিয়াম রিমুভ করলে পরের পুরোটাই খাওয়া যায়। চামড়ার ইলাস্টিন থাকার কারণে চামড়া টানটান থাকে।কোলাজেন টানটান অবস্থা ধরে রাখে। কোলাজেন ফাইব্রাস কানেক্টিভ টিস্যুর নিয়ে গঠিত, যা মূলত প্রোটিন বা আমিষ। বাচ্চাদের চামড়ার ইলাস্টিন কম, বড়দের বেশি থাকে। বড়দের চামড়ার কোলাজেন কম থাকে। এন্টিএজিং মেডিসিন গুলোতে কোলাজেন থাকে।
চামড়ার উপাদান যদি দেখি তাহলে পানি, আমিষ ৩৩%, ফ্যাট ২%। মাংসে আমিষ প্রায় ১৬%, ব্রয়লারে ২২% মাংসের দ্বিগুণ চামড়ায়। আবার প্রসেসিং করে চামড়ার নিচে ফ্যাট ছাড়ালে তা ১% এরও নিচে চলে আছে। ৩৩% আমিষের আমরা ৩০% খাই বাকি ৩% ফেলে দেই। একটা গরু থেকে আমরা ৪০-৬০ স্কয়ার ফিট এর চামড়া পেতে পারি। চামড়ার ওজন সাধারণত পুরো ওজনের ৭.৫% হয়।” সবশেষে তিনি চামড়া প্রক্রিয়াজাতকরণ সম্পর্কে ধারণা দেন।
অনুষ্ঠান শেষ হয় আমন্ত্রিত অতিথিদের চামড়া প্রক্রিয়াজাতকরণ এবং খাওয়ার অভিজ্ঞতা দিয়ে। অতিথিরা বলেন, “প্রথমে পরিবারের সবাই একটু অন্যরকম বোধ করলেও শেষে তৃপ্তি ভরে খেয়েছে, টেস্টই আলাদা”। উক্ত অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন ডা. মো: মোছাব্বির হোসেন (এসিআই এনিম্যাল হেলথ)।
Leave a Reply