ঢাকাস্থ কৃষিবিদ ইন্সটিটিউট বাংলাদেশ কেআইবি’তে গত ০৮-১০’ই জুলাই, ২০২৪ তারিখে ০৩দিন ব্যাপী এলডিডিপি রিসার্চ ও ইনোভেশন সাব প্রজেক্ট’স এবং এমএস/পিএইচডি(ন্যাশনাল) ফেলোশিপ প্রোগ্রাম সংক্রান্ত মিডটার্ম রিভিউ কর্মশালা অনুষ্ঠিত হয়। ০৮ জুলাই উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ডা. মো. রেয়াজুল হক।
উক্ত মিডটার্ম রিভিউ কর্মশালাতে এলডিডিপি প্রকল্পের অর্থায়নে ২২টি রিসার্চ ও ইনোভেশন সাব প্রজেক্ট’স ০১টি এমএস এবং ০৮টি পিএইচডি (ন্যাশনাল) ফেলোশিপ উপস্থাপন করা হয়। প্রকল্প দপ্তর হতে প্রদত্ত টেমপ্লেট অনুযায়ী এ সকল গবেষণা কার্যক্রমসমূহ উপস্থাপন করা হয়। উক্ত রিভিউ ওয়ার্কশপে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি, প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের মাঠ পর্যায়ের এবং অধিদপ্তরের বিভিন্ন কর্মকর্তা, সংশ্লিষ্ট গবেষক, ফেলো ও বিএলআরআই’র কর্মকর্তাগণ উপস্থিত ছিলেন।
২২ টি রিসার্চ ওয়ার্কের ভিতরে একটি উপস্থাপন করেন কৃষিবিদ প্রফেসর ড. মো. সিদ্দিকুর রহমান। তার প্রজেক্ট টাইটেল ছিলো- Transmission dynamics of brucellosis and abortion risk factors in large dairy herds in Bangladesh.
তিনি জানান, “ব্রুসেলোসিস গবাদি প্রাণির ব্যাকটেরিয়া জনিত একটি মারাত্মক জুনোটিক সংক্রামক রোগ। এই রোগটিতে আক্রান্ত হয় মূলত গরু, মহিষ, ছাগল, ভেড়া, শুকর ও কুকুর। রোগটিতে আক্রান্ত গাভীর গর্ভাবস্থার শেষের দিকে গর্ভপাত হয়। এছাড়া গবাদিপশুতে দুধ উৎপাদন হ্রাস, জরায়ু প্রদাহ, বাচ্চার মৃত্যু, দুর্বল বাচ্চার জন্মদান ও প্রজননের অক্ষমতা প্রভৃতি উপসর্গ প্রকাশের মাধ্যমে আমাদের দেশের ডেইরি শিল্পে কোটি কোটি টাকার আর্থিক ক্ষতি সাধন করে থাকে। বাংলাদেশসহ পৃথিবীর সব দেশেই রোগটির উল্লেখযোগ্য প্রাদুর্ভাব রয়েছে। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা যায় আমাদের দেশের গাভীতে ব্রুসেলোসিস রোগে আক্রান্ত হওয়ার সর্বোচ্চ হার ২০-২২% পর্যন্ত রয়েছে। বাংলাদেশের ছোট বড় বিভিন্ন খামারে প্রাদুর্ভাব থাকায় ডেইরি শিল্পে নীরবে আর্থিকভাবে ব্যাপক ক্ষতি সাধন করে যাচ্ছে। কিন্তু কাঙ্খিতভাবে রোগটিকে গুরুত্ব দিয়ে দেখা হয় না। ফলে আমাদের দেশের দুগ্ধশিল্পে কাঙ্খিত উন্নতি সম্ভব হচ্ছে না। ফলশ্রুতিতে বিদেশ থেকে কোটি কোটি টাকার দুগ্ধপণ্য আমদানি করতে হচ্ছে। গাতীর পাশাপাশি সিমেন উৎপাদনকারি ষাঁড় যদি এই রোগে আক্রান্ত হয় তাহলে কৃত্রিম প্রজনন প্রক্রিয়ায় ব্যাপক প্রভাব পড়ে এবং সিমেন দিয়ে প্রজননকৃত গাভীগুলোতে এ রোগ ছড়িয়ে যেতে পারে যা আমাদের পুরো ডেইরি শিল্পের জন্য হুমকি স্বরুপ। আক্রান্ত পশুর বর্জ্য, মাংস ও দুধের মাধ্যমে এ রোগ মানুষে ছড়ায় এবং এ রোগ মানুষে জ্বর, অকাল গর্ভপাত, বন্ধাত্ব, রেকাইটিস, ইপিডিডাইমাইটিস, যকৃত, প্লীহা, অস্থিসন্ধির প্রদাহসহ বিভিন্ন রোগ তৈরী করে থাকে। এমনকি শিশুদের মস্তিষ্ক আক্রান্ত হতে পারে।
বাংলাদেশ থেকে ১৯৬৭ সালে প্রথমবারের মতো ব্রুসেলোসিস গোভাইন বন্ধ্যাত্বের সাথে যুক্ত বলে জানা গেছে। এবং এখন পর্যন্ত শুধুমাত্র ব্রুসেলা অ্যাবরটাস বায়োভার ৩-এর খবর পাওয়া গেছে। ব্রুসেলা অ্যাবরটাসের অন্যান্য বাযোভার এবং ব্রুসেলার প্রজাতির উপস্থিতি অন্বেষণ করা দরকার। একটি রোগের বিস্তার অঞ্চল এবং পশুপালের উপর নির্ভর করে পরিবর্তিত হতে পারে। উচ্চ বিস্তৃত অঞ্চল এবং পশুপালকে চিহ্নিত করা সিদ্ধান্ত গ্রহণকারীদের উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চল এবং পশুপালকে কেন্দ্র করে নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে সক্ষম করে। যাইহোক, বাংলাদেশে ব্রুসেলোসিসের উপর পরিচালিত বেশিরভাগ গবেষণায় জীবিকা ব্যবস্থাপনা পদ্ধতির প্রাণীদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে যেখানে প্রাদুর্ভাব কম। তাই বাংলাদেশে এই রোগের সম্পূর্ণ মহামারী সংক্রান্ত বোঝার জন্য বিভিন্ন শ্রেণিবিন্যাস (প্রাণী-পালক-অঞ্চলে ব্রুসেলোসিসের ঘটনা, ঝুঁকির কারণ এবং বৃহৎ দুগ্ধপালনে বোভাইন ব্রুসেলোসিসের সংক্রমণ গতিবিদ্যা অধ্যায়ন করা প্রয়োজন। শ্রেণীবদ্ধ (প্রাণী-পাল-অঞ্চল-দেশ) এই রোগের ঘটনা এবং বাণিজ্যিক খামারে ঝুঁকির কারণগুলি নীতি নির্ধারকদের উচ্চ-ঝুঁকির পশুপাল, অঞ্চল, প্রাণী এবং ব্যবস্থাপনার পরিস্থিতিতে নিয়ন্ত্রণ এবং প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা শুরু করতে সক্ষম করবে। ট্রান্সমিশন গতিবিদ্যা মূল্যায়ন পশু অনাক্রম্যতা থ্রেশহোল্ড গণনা করতে সক্ষম হবে, প্রচলিত ব্রুসেলা প্রজাতির বিচ্ছিন্নতা এবং আশবিক বৈশিষ্ট্য প্রাদুর্ভাবের উৎস খুঁজে বের করতে সাহায্য করবে। রুসেলোসিস যেহেতু সত্যিকারের জুনোসিস তাই প্রাণীদের মধ্যে এই রোগের নিয়ন্ত্রণ মানুষের মধ্যে নিয়ন্ত্রণ করবে”।
কৃষিবিদ প্রফেসর ড. মো. সিদ্দিকুর রহমান আরো জানান, “নিওস্পোরা ক্যানিনাম, কন্দ্রিলা বানেটি, বোভাইন ভাইরাল ডায়রিয়া (বিভিডি) ভাইরাস এবং মাইকোব্যাকটেরিয়াম এভিয়াম উপ-প্রজাতি প্যারাটিউবারকুলোসিসের মতো আরও কিছু জীবাণু গর্ভপাত এবং বন্ধ্যাত্বের কারণ। দুধের নমুনা থেকেও এই জীবাণুগুলি সনাক্ত করা যায়। প্রকল্পের সুবিধা পরোক্ষভাবে ব্রুসেলা মুক্ত গবাদি পশু উৎপাদনের মাধ্যমে খাদ্য নিরাপত্তা বৃদ্ধির সাথে সম্পর্কিত যা স্বাস্থ্যকর জাতি গঠনের জন্য মানসম্পন্ন পশু প্রোটিন উৎপাদন (দুধ, মাংস) বৃদ্ধি ও নিশ্চিত করে। ফলস্বরূপ, গবেষণার বিষয় সম্পর্কিত যা সরাসরি স্বাস্থ্য সুবিধার সাথে সম্পর্কিত যা এসডিজি ৩ (এসডিজি ৩: সুস্বাস্থ্য এবং সুস্থতা) সম্পর্কিত। শেষ পর্যন্ত এই প্রকল্পটি একটি সুস্থ বাংলাদেশ গড়তে এবং এর মাধ্যমে এসডিজি ৩ অর্জনে সহায়তা করবে।
এই অধ্যয়নে সিলেট, চট্টগ্রাম, বরিশাল, ফরিদপুর, রাজশাহী, বগুড়া, যশোর, বাগেরহাট, ভোলা, সাতক্ষীরা, পাবনা, সিরাজগঞ্জ, ময়মনসিংহসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলা জুড়ে ৭টি সরকারি দুগ্ধ খামার এবং ৬৭টি বেসরকারি দুগ্ধ খামারকে সম্পৃক্ত করে একটি আন্তঃবিভাগীয় সমীক্ষা পরিচালিত হয়েছিল। বাছাই করা পশুদের থেকে বান্ধ দূধ প্রাথমিকভাবে পরোক্ষ উখওকঅ (রউখওবাঅ) ব্যবহার করে ব্রুসেলোসিসের জন্য স্ক্রীন করা হয়েছিল এবং ইতিবাচক পশুদের থেকে পৃথক গরুর দুধ রউঘওকঅ ব্যবহার করে আরও পরীক্ষা করা হয়েছিল। ১৩১টি পরীক্ষিত বান্ধ দুধের নমুনার মধ্যে, ৩৮.৯% (৫১) ইতিবাচক এবং ৩১% (৩২৯টির মধ্যে ১০২) পৃথক গরুর দুধের নমুনা ব্রুসেলোসিসের জন্য পজিটিভ পাওয়া গেছে। পশুপালের পর্যায়ে ব্রুসেলোসিসের প্রাদুর্ভাব ছিল যশোর (১০০%), সিরাজগঞ্জ (৭৫.০%), সাতক্ষীরা (৫৫.৬%), বরিশাল (৫০.০%), ফরিদপুর (৫০.০%), সিলেট (৪২.৯%), বাগেরহাট (৩৩.০%), রাজশাহী (৩৩.০%), বগুড়া (৩৩.০%), চট্টগ্রাম (২৫.০%), পাবনা (২২.২%), ভোলা (১৭.৭১%) এবং ময়মনসিংহ (০.০%) যেখানে গরুর স্তরের প্রাদুর্ভাব ছিল যশোর (১০০%), চট্টগ্রাম (৭৩.৭%), বাগেরহাট (৪৫.২%), সিলেট (৩৬.৫%), রাজশাহী (২৮.৩%), ফরিদপুর (১২.৮%), বরিশাল (৮.৪%) এবং বগুড়া (২.০%)। বাংলাদেশে বৃহৎ দুগ্ধপালনকারী পশুপালনে বোভাইন ব্রুসেলোসিসের প্রাদুর্ভাব পাল এবং গরু উভয় স্তরেই উল্লেখযোগ্যভাবে বেশি। ব্যাপকতার আঞ্চলিক বৈচিত্র লক্ষ্যযুক্ত হস্তক্ষেপের প্রযোজনীয়তা তুলে ধরে। সঠিক রোগ নির্ণয় এবং কার্যকর ব্যবস্থাপনার কৌশল নিশ্চিত করতে ইতিবাচক পশুপালক ও গরুর জন্য রিয়েল-টাইম পিসিআর ব্যবহার করে নিশ্চিতকরণ পরীক্ষার সুপারিশ করা হয় এবং অধ্যয়ন চলছে”।
তিন (০৩) দিনব্যাপী এই রিভিউ ওয়ার্কশপে রিপোর্টার হিসেবে ড. এ. বি. এম মুস্তানুর রহমান, অতিরিক্ত পরিচালক (উপ-সচিব), বিএলআরআই এবং ড. মোঃ আহসান হাবিব, জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা, প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর উপস্থিত ছিলেন। একইসাথে তিন (০৩) দিনব্যাপী রিভিউ ওয়ার্কশপ ডাঃ কাবিউন নেসা, উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা সঞ্চালকের দায়িত্ব পালন করেন।
১০’ই জুলাই, ২০২৪ তারিখে সমাপনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব সাঈদ মাহমুদ বেলাল হায়দর জুম প্লাটফর্ম এ উপস্থিত ছিলেন। সমাপনী অনুষ্ঠানে এলডিডিপি রিসার্চ এবং ইনোভেশন সাব প্রজেক্টস এবং এমএস/পিএইচডি (ন্যাশনাল) ফেলোশিপ প্রোগ্রাম এর জন্য প্রিন্সিপাল ইনভেস্টিগেটর এবং ফেলোস নির্বাচন সংক্রান্ত সংক্ষিপ্ত উপস্থাপনা প্রকল্পের চিফ টেকনিক্যাল কো-অর্ডিনেটর ড. মোঃ গোলাম রব্বানী উপস্থাপন করেন। অনুষ্ঠানের সভাপতি মোঃ আব্দুর রহিম, প্রকল্প পরিচালক, এলডিডিপি ০৩ (তিন) দিনব্যাপী মিডটার্ম রিভিউ ওয়ার্কশপ এর সমাপ্তি ঘোষনা করেন।
Leave a Reply