কক্সবাজারের চকরিয়া উপজেলার নারী উদ্যোক্তাদের সংগঠন চকরিয়া হস্তশিল্প ও দেশীয় পণ্য উৎপাদন মুখী সমবায় সমিতি লিঃ এর সভাপতি শারমিন জন্নাত ফেন্সিকে কোন বাঁধা -ই দমিয়ে রাখতে পারেনি। এগিয়ে চলছে স্বমহিমায়। এই নারী উদ্যোক্তা বলেন, ২০১৯ এর অক্টোবরে কক্সবাজারে অনুষ্ঠিত নারী নেতৃত্ব বিকাশ শীর্ষক ২১৫ তম ব্যাচের প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণ করি আমি। এই প্রশিক্ষণ আমাকে মনের দিক থেকে অনেক জোর এনে দেয়। বুঝতে পারি দক্ষিণ অঞ্চলের নারীরা অনেক পিছিয়ে আছে। কুসংস্কার-পারিবারিক নানা বাধা-বিপত্তি তাদের আষ্টে-পৃষ্ঠে
রেখেছে। সেই বাধা-বিপত্তি অতিক্রম করে আমি সফল হয়েছি। শুধু নিজে সফল হয়ে থেমে থাকিনি এখন তৃণমূল নারীদের সফলতার জন্য কাজ করছি। নিজের সফলতার কথা এভাবেই বললেন শারমীন। ঘরে বেকার বসে না থেকে কীভাবে স্বাবলম্বী হওয়া যায় সেই পথের সন্ধানে বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনের সাথে যুক্ত হন তিনি। দি হাঙ্গার প্রজেক্ট এর বিকশিত নারী নেটওয়ার্ক ও আন্তর্জাতিক সেচ্ছাসেবী সংগঠন এপেক্স বাংলাদেশের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। শারমীন জান্নাত ফেন্সী ১৯৮৮ সালের ৩১ মে চকরিয়া উপজেলার কোনাখালীতে জন্মগ্রহণ করেন। শারমীন জান্নাতের বাবা জাফর আলম সিদ্দিকি একজন সমাজসেবক ও রাজনীতিবীদ। মা ইশরাত জাহান ঝর্ণা উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা অফিসের এফডাব্লিউএ হিসেবে কর্মরত। দুই বোন তিন ভাইয়ের মধ্যে শারমীন জান্নাত ফেন্সী সবার বড়। ফেন্সী ছিলেন ছাত্রী হিসেবে খুব-ই মেধাবী। প্রতিবছর-ই ক্লাশে প্রথম হতেন। পড়শোনার পাশাপাশি খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ ছিল সমান তালে। বাবা-মায়ের ধারণা ছিল গ্রামে থাকলে পড়াশোনা ঠিকমত হবে না, তাই তারা চলে আসেন চকরিয়া পৌরশহরে। এখান থেকেই চালিয়ে যান পড়াশোনা। কলেজে দ্বিতীয় বর্ষে পড়ার সময়-ই বিয়ে হয়ে যায় ফাঁসিয়াখালী ইউনিয়নের বাসিন্দা আবুল মনসুর মোঃ মহসিনের সাথে। মহসিন ছিলেন বড়ছেলে, তাই ফেন্সীর কাঁধে এসে পড়ে সংসারের বড় বউয়ের দায়িত্ব। বন্ধ হয়ে যায় পড়াশোনা । শ্বাশুড়ি চাইতেন বউমা সংসারী হোক। এদিকে বিয়ের চারবছরেও কোন সন্তান না হওয়ায় শোনতে হয় আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশীর বিভিন্ন ধরনের প্রশ্ন! ঘরে বেকার বসে থাকা এবং মানসিক এইসব যন্ত্রণা থেকে রেহায় পেতে চাইতেন তিনি। ঔষুধ কোম্পানির চাকুরীজীবী স্বামীকে নিয়ে বেরিয়ে পড়েন যৌথ সংসারের বেড়াকল থেকে। অবশেষে খুঁজে পান নিজেকে মুক্তির পথ। সেই মুক্তির পথের কথা ফেন্সি নিজেই জানালেন- ‘আসলে বসে থাকতে ভালো লাগছিল না। আমি স্বপ্ন দেখতাম নিজে কিছু করার। স্বাবলম্বী হবার। তাই আবার ২০১০ সালে ভর্তি হলাম এইচএসসি তে বাউবিতে। ২০১২ সালে এইচ এসসি পাস করি চকরিয়া সরকারী কলেজ থেকে। এরপর আবার বাউবিতে কক্সবাজার সরকারি কলেজে বিএসএস ভর্তি হই।স্বাবলম্বী হব, কিন্তু চাকরি করার ইচ্ছা ছিল না। আমি এমন কিছু করব যেখানে আরো শত-শত নারীও স্বাবলম্বী হতে পারবেন। ভাবনায় ছিল নিজের উন্নয়ন এবং সঙ্গে অসহায় নারীদের পাশে দাঁড়ানো। এই ভাবনায় পথ চলছিলেন ফেন্সি। এর-ই মাঝে দুই সন্তানের জন্ম। সন্তান প্রতিপালনের সঙ্গে সঙ্গে চলছিল স্বাবলম্বী হওয়ার স্বপ্ন দেখা। স্বামী মনসুর মহসিন ছিলেন স্বেচ্ছাব্রতী উজ্জীবক। তার সহযোগিতায় শুরু করেন নিজের পায়ে দাঁড়ানো সংগ্রাম। ফেন্সি অনুধাবন করলেন – এই অন্ধকার থেকে বের হতে হবে। নারীদের মনের বিকাশ করতে হবে।
সেই অনুযায়ি এলাকার অবহেলিত নারীদের স্বাবলম্বী করে তোলার লক্ষ্যে কাজ শুরু করেন। নারীর প্রতি সহিংসতা বন্ধে নির্যাতিত নারীদের আইনি সহায়তা প্রদান, স্বাস্থ্যসেবা বঞ্চিতদের স্বাস্থ্যসেবা দিয়ে থাকেন। গ্রামের অসচ্ছল পরিবারের অনেক মেয়ে-যৌতুক দিতে না পারার কারণে যাদের বিয়ে হচ্ছিল না-এ রকম ২৫ জন নারীকে বিভিন্ন আয়বর্ধনমূলক কাজ করতে উৎসাহ প্রদান করেন। চকরিয়ার বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে থাকা ৮০ জন নারী উদ্যোক্তাদের একত্রিত করে ২০২০ সালে শুরু করেন ই-কমার্স ভিত্তিক সংগঠন চকরিয়া হস্তশিল্প ও দেশীয় পন্য উৎপাদন মুখী সমবায় সমিতি। চকরিয়া ক্ষুদ্র মহিলা উদ্যোক্তাদেরকে সঠিক একটা প্লাটফর্ম তৈরি করে দেওয়ায় ছিল তার সংগঠনের মূল লক্ষ্য। গ্রামে গঞ্জে অনেক নারী আছেন যারা হস্তশিল্পের কাজ করেন। তিনি চান তাদের কাজগুলোকে মানুষের কাছে তুলে ধরতে। সমগ্র বাংলাদেশে চকরিয়ার হস্তশিল্পকে পরিচয় করিয়ে দিতে। ইতিমধ্যে এর ব্যাপক পরিচিতি লাভের জন্য এই উদ্যোক্তা সংগঠনের পক্ষ থেকে চকরিয়ায় ২০২১ ও ২০২২ সালে উপজেলা প্রশাসনের সহযোগিতায় করা হয় বিশাল হস্তশিল্প মেলা। এই মেলার মাধ্যমে জানান দেওয়া হয়েছে এই অঞ্চলের নারীরা পিছিয়ে নেই। তারাও নিজ উদ্যোগে সফল হতে পারে। এছাড়াও তার সংগঠনের মাধ্যমে করোনা মহামারীরতে ১০০০ জনকে হাতের তৈরি মাস্ক, ২৫০ জনকে খাবার সামগ্রী বিতরণ করা হয়েছে। এতিমখানায় শিশুদের শীতের কাপড় এবং জায়নামায দেয়া হয়েছে। তার সংগঠনে বর্তমানে আড়ইশ নারী উদ্যোক্তা কাজ করছে বলে জানান তিনি। নারী উদ্যোক্তাদের পাশাপাশি তিনি আন্তর্জাতিক সেচ্ছাসেবী সংগঠন এপেক্স বাংলাদেশের আওতাধীন এপেক্স ক্লাব অব চকরিয়া সিটি’র ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করে এলাকার কম ভাগ্যবান ও পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর ভাগ্যোন্নয়েনে কাজ করে যাচ্ছেন সফল এই নারী।
Leave a Reply