আজকের দিনের তরুণ তরুণীরা কেমন যেন লাগামহীন ও বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে বিষবাষ্প ছড়িয়ে ধ্বংসের তলানিতে অবস্থান করছে।
তরুণ সমাজের নৈতিক অবক্ষয়ের দোষ কে নেবে, পরিবার, সমাজ, নাকি রাষ্ট্র?
প্রযুক্তির উৎকর্ষতা বলি কিংবা এর সহজলভ্যতাই বলি তরুণ সমাজের ধ্বংসের মূলে রয়েছে এসব আধুনিক চিত্ত বিনোদনের সামগ্রী। হাত বাড়ালেই সহজলভ্য পণ্য খুব সহজেই পেয়ে যাচ্ছে আমাদের যুব সমাজ। তবে প্রযুক্তিকে আমি একপাক্ষিক দোষ দিচ্ছি না। সন্তানকে ধ্বংসের লাকড়ি হিসেবে একেকটি পরিবার অগ্রণী ভূমিকা রাখছে। যেসব পরিবার তাদের সন্তানদের অবাধ চলাচলে নিষেধাজ্ঞা প্রণয়ন করে না সেসব বাবা মা এর দায় এড়াতে পারবে না।
কেন আমি মা বাবা কিংবা সন্তানের বেড়ে ওঠার কেন্দ্রবিন্দু একটি পরিবারকে দায়ী করলাম। এর সদুত্তর হয়তো খুব সহজেই পাওয়া যাবে। কিন্তু এর সমাধান কিন্তু ততটা সহজ নয়। বাল্যকালে একটি কথা শুনেছিলাম মুরব্বিদের মুখে, ‘সন্তানকে ছোট থাকতে শাসন করিনি কষ্ট পাবে বলে, বড় হওয়ার পর শাসন করি না আঘাত করবে বলে।’
আসলে সন্তান যখন ছোট থাকে তখন থেকেই তাকে চারপাশের পরিবেশ এবং ভদ্রতা সমন্ধে শিক্ষা দিতে হয়। না হলে বড় হওয়ার পর সে বদমাশ এবং বেয়াদব বৈকি অন্য কিছু হবে না।
ছোটবেলায় অনেক শিক্ষাই আমাকে আমার পিতা দিয়েছিলেন। সেগুলো যে হীরা বা জহরত থেকে অমূল্য তা আজকে হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি। অনেক বড় ঘরের আদরের দুলাল রয়েছেন যারা সেসব প্রকৃত শিক্ষার আড়ালে রয়েছেন বলে অনেক কিছুই তাদের নিকট অস্পষ্ট। আর এই অস্পটতার কারণেই তারা অনেক বড় অপরাধ করতে কুন্ঠা বোধ করেন না।
বাল্যকালে যখন পিতা আমাকে বুকে জড়িয়ে ঘুম পারাতেন বলে আমি আমার পিতার অনেক উপদেশ এবং শিক্ষা খুব সহজে পেয়েছিলাম। তিনি হয়তো আমাকে অঢেল ধন সম্পত্তি দিয়ে যেতে পারেননি বলে তিনি আমাকে বলেছিলেন, টাকা দিয়ে তোমাকে ধন্য করার কোন ইচ্ছেই আমার নেই তবে তোমাকে মানুষ বানানোর সদিচ্ছা আমায় বাঁচিয়ে রাখবে হাজার বছর।
পিতার হাজারো উপদেশের মাঝে দুটি কথা এখনও আমার রক্ত কনিকায় অনবরত প্রবাহিত হয়।
এক, আমার বয়স তখন ৩ কিংবা ৪ বছর। আমার খুব স্পষ্ট মনে পড়ে একদিন রাস্তা থেকে আমি ১০০ টাকা কুড়িয়ে পেয়েছিলাম। আমার পরম শ্রদ্ধেয় পিতার নিকটে খুব খুশি মনে উপস্থাপন করলাম। তিনি আমাকে একটি জোরেসোরে ধমক দিয়ে আমার অন্তরাত্মা শুকিয়ে ফেল্লেন। আমি ভয় পেয়েছি দেখে পরক্ষণে শান্ত গলায় আমাকে বুঝিয়ে বল্লেন, ‘যেখান থেকে তুমি এই নোটটা পেয়েছো সেখানে রেখে আসবে।’ তারপর পিতা আমাকে সাথে করে নিয়ে সেই জায়গায় উপস্থিত হলেন (যেখান থেকে আমি টাকা পেয়ছিলাম), এবং আমি তার আদেশেই সেখানে বাধ্য ছেলে হয়ে টাকা ফেলে দিলাম।
সেই থেকে আমি আজ পর্যন্ত কুড়িয়ে পাওয়া কোন জিনিস হাতে নেইনি।
দুই, প্রথম উদাহরণটির মতোই এই উপদেশটি অভিন্ন ঘরানার। আমার মাথার মুকুট পিতা আমাকে অন্যের গাছের ফল খেতে নিষেধ করেছিলেন বলে আজ অব্দি কারো গাছের ফল অবৈধভাবে খেয়েছি বলে মনে পরে না।
আমাদের নব্বইয়ের দশকের ছেলেমেয়েরা বাবা মা’কে অনেক ভয় করতাম ঠিকই কিন্তু তাদের কথার অবাধ্য হওয়ার মতো সন্তান খুঁজে পাওয়াটা দুষ্করই ছিলো বটে।
নব্বইয়ের দশকের পরে থেকে আমাদের দেশের সমাজ সাংস্কৃতি আধুনিকায়ন হওয়ার সাথে সাথে ধ্বংসের অতল গহ্বরে অবস্থান হারিয়ে যাচ্ছে।
সবার ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে দিয়ে ব্যাপারটাকে বিদঘুটে করার কোন ইচ্ছে আমার নেই। এখনও আমাদের সমাজে অনেক পরিবার রয়েছেন যারা সন্তানকে মার্জিত রুচিবোধ এবং আদবকায়দা শিক্ষা দিয়ে থাকেন। এসব পরিবার থেকে উঠে আসা সন্তানেরা সাধারণত দেশ এবং সমাজের জন্য ক্ষতিকর কোনকিছু করেন না বলেই আমার দৃঢ় বিশ্বাস।
একটু আগে আমি যে কথাটি বলেছিলাম মার্জিত রুচিবোধ এবং ভদ্রতা শিক্ষা দেয়ার মাধ্যমেই সন্তান ভালো হবে। কোন পিতামাতাই চান না তাদের সন্তান অবাধ্য এবং বেপরওয়া হোক। সবারই মনের সুপ্ত ইচ্ছে তাদের সন্তান শিক্ষা-দীক্ষায় প্রথম সারিতে অবস্থান করবে। কিন্তু দুঃখের কথা হচ্ছে পিতামাতা নিজ সন্তানকে আদবকায়দা শিক্ষা দিতে নারাজ।
কেননা সন্তানকে নৈতিকতা শিক্ষা দিতে যে পথ অবলম্বন করা দরকার সেই পথে তারা হাঁটেন না। তারা হাঁটেন ঠিক উল্টো পথে। কেননা সন্তান অন্যায় করলে তাকে ধমকের সুরে কথা বল্লে যদি কষ্ট পায় এজন্য অধিকাংশ বাবা মা তার সন্তানকে কথিত স্নেহের নামে ধ্বংসের পথে ঠেলে দিচ্ছেন। এটা অনেকেই বুঝতে পারেন না। এর ফলশ্রুতিতে সন্তান বড় হয়ে মা বাবার অবাধ্য হওয়া সহ সমাজের ক্ষতির কারণ হয়ে দাড়ায়।
উঠতি বয়সি ছেলেমেয়েরা এসময় আরো বেপরোয়া হয়ে উঠছে। অপসাংস্কৃতি গ্রহণ এবং নিজস্ব স্বকীয়তা বর্জনের কারণে আমরা ভবিষ্যতে একটি মেরুদন্ডহীন জাতি যে পেতে যাচ্ছি তাতে কোন সন্দেহ নেই।
লিখার শুরুতে যে বিষয়টি উল্লেখ করেছিলাম সেটিকে দ্বিতীয়বার লেখার মধ্যে এনে পাঠকদের বিরক্ত করার জন্য দুঃখ প্রকাশ করছি।
প্রযুক্তির সহজলভ্যতা এবং পরিবারের খামখেয়ালিপনার জন্য সম্ভাব্য তারুণ্য পাচ্ছি না। শহরের অলিতে গলিতে চলার সময় একটু এদিক ওদিক চোখ ঘোরালে দেখা যায় উঠতি বয়সি যুবকেরা জটলা বেধে বসে স্মার্টফোন হাতে নিয়ে কি যেন করছে।
তাদের আশেপাশ দিয়ে কে গমন করলো সেদিকে তাদের ভ্রুক্ষেপ নেই। পড়াশুনা বাদ দিয়ে তারা রাস্তার পাশে বসে এগুলো করে বেড়াচ্ছে। এর ফলে কিশোর অপরাধ বেশি হচ্ছে। ওই যে কথায় আছে, অলস মস্তিষ্ক ভূতের কারখানা।
সেদিন ক্লাস সিক্সে পড়ুয়া আমার এক ছাত্র আমাকে বল্লো, স্যার আপনাকে ফেইসবুকে ফ্রেন্ড রিকুয়েস্ট পাঠিয়েছি এক্সেপ্ট করবেন। আমি একটু উৎসাহী হয়ে জিজ্ঞেস করলাম তোমাদের মাঝে কে কে ফেইসবুক ইউজ করো?
আমার প্রশ্নে কিছুটা বিব্রত হলেও পরক্ষণে বেশ কয়েক জনকে হাত উচু করতে দেখেছিলাম।
এরপর তারাই আমাকে ফ্রি ফায়ার আর পাবজি’র বিষয়টা বুঝিয়ে দিলো।
ব্যাপারটা যতটা না মজার তার থেকে বেশি ভয়ংকর। আমাদের সময়ে আমরা ফেইসবুকের নামই জানতাম না। এখন তাদের হাতে ফোন এলো কিভাবে, প্রশ্নটা থেকেই যায়। আমি এখানে সম্পূর্ণ দায়ভার তাদের পরিবারকেই দেবো।
এর সাইড ইফেক্ট কিন্তু তাদের ওপর খুব ভালোমতোই পড়ছে। তারা পড়াশুনায় ফাঁকিবাজি থেকে শুরু করে শিক্ষকদের অবমাননা করা সহ জড়িয়ে পড়ছে বিভিন্ন অনৈতিক কাজে।
এ থেকে উত্তরণের পথ আমাদেরকেই খুঁজে বের করতে হবে।
সবার আগে পরিবারকে সচেতন হবে। আপনার সন্তানের খোঁজ খবর পিতামাতা যদি না রাখেন তাহলে সেই সন্তান কখনো আগাতে পারবে না।
যারা বাবা মা আছেন তারা সন্তানকে আদর করতে গিয়ে যেন নৈতিক অবক্ষয় ডেকে না আনেন সে বিষয়ে লক্ষ্য রাখবেন। আপনার সন্তানকে স্নেহ, ভালোবাসা দিবেন কিন্তু সেটা যেন মাথায় উঠিয়ে না হয়। মনে রাখবেন সন্তান বাবা মায়ের কথায় চলবে কিন্তু সন্তানের কথায় বাবা মা চলতে পারে না।
অপসাংস্কৃতি বর্জন করা সহ সন্তানকে ধর্মীয় শিক্ষা দিতে হবে। সন্তানের ভালো মন্দের দায়িত্ব বাবা মায়ের এটা যেন কেউ ভুলে না যাই।
কথায় আছে সঙ্গ দোষে পাথর ভাসে। সেহেতু সন্তান কার সাথে সময় কাটায় সেদিকে লক্ষ্য না রাখলে সন্তান তো তলানিতে অবস্থান করবেই।
আমাদের দেশে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা দিনদিন বেড়েই চলছে। এই শ্রোত যদি আমরা না ঠেকাতে পারি তবে বড় বড় ধাক্কা খাওয়ার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থার আমুল পরিবর্তনই পারে এই অবস্থার পরিবর্তন ঘটাতে। প্রত্যেকটি শিক্ষার্থীকে কারিগরি শিক্ষা নিশ্চিত করার মাধ্যমে বেকার সংখ্যা শূণ্যের কোটায় নামিয়ে আনা সম্ভব।
প্রত্যেকটি উপজেলায় যুব উন্নয়ন কেন্দ্র রয়েছে যেখানে যুবকদেরকে কারিগরি ট্রেনিং দেয়ার মাধ্যমে দক্ষ এবং কর্মঠ যুব শক্তি গড়ে তোলা হয়।
অনেকেই বিষয়টি সম্পর্কে জানেন না। তাদের উদ্দ্যেশেই কথাগুলো বলা। এতে করে শিক্ষিত বেকার যেমন কমবে তেমনিভাবে জনসংখ্যা জন শক্তিতে রুপান্তর হবে। তারুণ্যের শক্তিতে আমরা বিশ্বের দরবারে মাথা উচু করে দাড়াবো।
আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে হবে। দোষটা আমাদের সমাজের, আমরা কারও উন্নতি সহ্য করতে পারি না। কেউ ভালো কিছু করলে তাকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য থেকে শুরু করে দমিয়ে পর্যন্ত রাখি।
যুবকদেরকে ভালোবাসা দিয়ে আগলে রেখে ভালো কাজের উপদেশ দিতে হবে। তারা কিন্তু আমাদের কটু কথা সহ্য করতে পারেন না।
পর্যাপ্ত কর্ম সংস্থান সৃষ্টি সহ তাদের প্রতি সহনশীল হলে সমাজ পরিবর্তন হবে।
একটু আগে বলেছিলাম, আমাদের দৃষ্টি ভঙ্গি পরিবর্তনের কথা। সত্যিই দৃষ্টি ভঙ্গি খুব গুরুত্বপূর্ণ। কোন কাজকে ছোট হিসেবে উপস্থাপন করা যাবে না।
এলাকা, পাড়া, মহল্লায় যুব সমাজকে নিয়ে বিভিন্ন কর্মমুখী এবং সেচ্ছাসেবী সংগঠন গড়ে তোলার মাধ্যমেও পরিবর্তন সাধিত হবে। এছাড়াও যারা শিক্ষিত শ্রেণী রয়েছে তাদেরকে নিয়ে রেগুলার বিভিন্ন জন সচেতনতামূলক ক্যাম্পেইন করার মাধ্যমে অবস্থার পরিবর্তন ঘটানো সম্ভব।
লেখকঃ আব্দুল্লাহ আল মামুন
Leave a Reply