“ভাবুক এবং ভ্রমণকারী দুনিয়ার শ্রেষ্ঠ দরবেশ”,
হয়ত ‘শেখ সাদীর’ এই বিখ্যাত উক্তিকে লালন করে আধুনিক বাংলার কৃষি সমাজকে স্মার্ট ছোঁয়া দিতে চাওয়া হকৃবির মাননীয় উপাচার্য মহোদয় ড.আব্দুল বাসেত স্যার হবিগঞ্জ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি অনুষদের শিক্ষা কর্মসূচিতে প্রতি সেমিস্টারে একাডেমিক ট্যুরকে তথা কোর্স রিলেটেড ফিল্ড ট্রিপ বাধ্যতামূলক করেছেন। তারই ধারাবাহিকতায় লেভেল -০১,সেমিস্টার-০২ এর হকৃবি’র ‘অ্যানিমেল সাইন্স এন্ড ভেটেরিনারি মেডিসিন’ (এএসভিএম) অনুষদের শিক্ষার্থীরা হবিগঞ্জ থেকে চট্টগ্রাম এবং কক্সবাজারে ৩ দিন ব্যাপী ফিল্ড ট্রিপ সফলভাবে সম্পন্ন করেছে।
৩ দিন ব্যাপী শিক্ষা সফরের উদ্দেশ্যে শিক্ষার্থীরা যাত্রা শুরু করে গত ৩০ জানুয়ারি রাত ১০ টায় হকৃবি ক্যাম্পাস থেকে দুরন্ত গতিতে ছুটে চলা দুরন্ত বাসে চেপে। যেখানে শিক্ষার্থীদের সাথে আরও উপস্থিত ছিলেন শিক্ষার্থীদের একান্ত প্রিয়ভাজন, উক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মানিত শিক্ষকবৃন্দ; ডা. রহিমা আক্তার দিপা, প্রভাষক ও বিভাগীয় প্রধান (ভারপ্রাপ্ত), ফিজিওলজি, ফার্মাকোলজি এন্ড টক্সিকোলজি বিভাগ; ডা. শিরিনা আক্তার তমা, প্রভাষক ও বিভাগীয় প্রধান (ভারপ্রাপ্ত), অ্যানিমেল সাইন্স বিভাগ; অস্থায়ী ছাত্রী হলের সহকারী হল প্রভোস্ট ডা: জাকিয়া সুলতানা কলি, প্রভাষক ও বিভাগীয় প্রধান (ভারপ্রাপ্ত), অ্যানিমেল নিউট্রেশন বিভাগ; ডা: সালাউদ্দীন ইউছুপ, প্রভাষক ও বিভাগীয় প্রধান (ভারপ্রাপ্ত), এনাটমি এন্ড হিস্টোলজি বিভাগ।
রাত ভর আধো ঘুমের ভ্রমণের পর যখন সকালে চোখ খুলে শিক্ষার্থীরা নিজেদেরকে ‘চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি ও এনিম্যাল সাইন্সেস বিশ্ববিদ্যালয় (সিভাসু) ক্যাম্পাসে আবিষ্কার করে। ঘন কুয়াশা আর হালকা শীতে শিক্ষার্থীরা খানিকটা কাবু হলেও নতুন কে জানার নেশা তাদেরকে লক্ষ্যে অটল রেখেছিল। সিভাসুর হলের গেস্ট রুমে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে পরিপাটি হয়ে সকলেই বেরিয়ে পড়ে। সকালের নাস্তা করে সবাই মিলে তাদের মিশনে নেমে পড়ে প্রিয় শিক্ষকদের সাথে শত ঐতিহ্যের ও আবহমান কাল ধরে শীর্ষে থাকা দেশ সেরা প্রাণিচিকিৎসার প্রধান ঘাটিতে।
প্রথমেই শিক্ষার্থীরা ঘুরে দেখে এনাটমি এন্ড হিস্টোলজি মিউজিয়াম যেখানে স্হান পেয়েছে বহু প্রাণীর কংকাল এবং ভিসেরাল অর্গান; সিংহ থেকে নিয়ে কবুতর পর্যন্ত।তারা আরও অবলোকন করে বিভিন্ন প্রাণীর ভ্রণ ও বিকাশ। হকৃবির এনাটমি ও হিস্টোলজির প্রধান ডা. সালাউদ্দীন ইউছুপ বিভিন্ন প্রজাতির প্রাণীর কংকাল, তাদের দেহের বিভিন্ন অংশ বিশেষ এবং তাদের গঠন প্রণালী ও কার্য প্রণালী সম্পর্কে চুল চেরা বিশ্লেষণ করেন যা শিক্ষার্থীদের অন্যরকম তৃপ্তি দিয়েছে।
এনাটমি মিউজিয়ামের ঘুরে দেখার পর শিক্ষার্থীরা ফিজিওলজির বিভিন্ন ল্যাব ও কোর্স কারিকুলাম এবং ক্যারিয়ার বিষয়ক বিভিন্ন বিষয় জানতে পারে সিভাসুর ফিজিওলজি, বায়োকেমিস্ট্রি এন্ড ফার্মাকোলজি বিভাগের প্রধান প্রফেসর ড. শাহনেওয়াজ আলী খানের প্রত্যক্ষ উপস্হিতিতে এবং ল্যাব দেখানোর সার্বিক তত্ত্বাবধানে ছিলেন ফিজিওলজি, বায়োকেমিস্ট্রি ও ফার্মাকোলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. মো. সোহেল আল ফারুক এবং হকৃবির ডা. রহিমা আক্তার দিপা ম্যাম।
তারপর শিক্ষার্থীরা, ডা. শিরানা আক্তার তমা ও ডা. জাকিয়া সুলতানা কলি ম্যামের প্রত্যক্ষ উপস্হিতিতে এনিমেল সাইন্স এন্ড নিউট্রিশন বিভাগের প্র্যাকটিকালের বিভিন্ন যন্ত্রপাতি প্রত্যক্ষ করে যার মধ্যে ছিল বিভিন্ন প্রজাতির এনক্লোজার ডিজাইন, গ্রুমিং এর জন্য ব্যবহৃত বিভিন্ন ব্রাশ, শেয়ারিং টুলস, রেসটেইনিং টুলস, ট্যাগ মার্ক সহ অনেক অনেক ব্যবহারিক ইন্সট্রুমেন্ট এবং এনিম্যাল নিউট্রেশনের বিভিন্ন ফোডার, বীজ ও রেশন ফর্মুলেশনের বিভিন্ন তথ্য। বেলা গড়িয়ে দুপুর হলে লাঞ্চের পরে শিক্ষার্থীরা ফিস মিউজিয়াম এবং সর্বশেষ সিভাসুর অত্যাধুনিক এস. এ. কাদেরী টিচিং ভেটেরিনারি হসপিটাল ঘুরে দেখে যেখানে অপারেশন থিয়েটার এবং একটি সার্জারি দেখার মাধ্যমের তাদের সিভাসু ক্যাম্পাস সফরের অংশ সম্পন্ন হয়।
পড়ন্ত বিকেলে আবারো দুরন্ত গতিতে ছুটে চলে বাস। এবার গন্তব্যস্হল চট্টগ্রাম চিড়িয়াখানা, ফয়েজ লেক। সারা বিকাল শিক্ষার্থীরা জু তে অবস্হান করে এবং ‘পেট, জু, ল্যাব এবং ওয়াইলড লাইফ কনজারভেশন’ কোর্সের অন্তর্ভুক্ত প্রায় সকল প্রাণীর চাক্ষুষ দেখা মেলে জু তে যার মধ্যে অন্যতম ছিল বাঘ, সিংহ, মেকাকিউ, হরিণ, জলহস্তী, ভাল্লুক, গাওয়র, পাইথন, জেব্রা সহ বিভিন্ন প্রজাতির প্রাণী ও পাখি। জু পরিদর্শন শেষে শিক্ষার্থীরা আবার বাসে উঠে এবং কক্সবাজারের উদ্দেশ্যে রওনা হয়। পশ্চিমাকাশে লালিমা দেখতে দেখতে কখন যে সবাই ঘুমে হারিয়ে যায় তা কেউ টের পায় নি হঠাৎ সবার চেচামেচিতে ঘুম ভাঙ্গে তখন চট্টগ্রাম কোনো এক হোটেলে আমরা রাতের খাবার শেষ করি।পরক্ষণেই আমরা গাড়িতে উঠি এবং যাবার পথে সদ্য উন্মুখ হওয়া বঙ্গবন্ধু টানেল অতিক্রম করি এবং দ্বিপ্রহরের পর পরই আমরা আমাদের কাঙ্খিত আবাসস্হল (গেস্ট হাউস, সিভাসু) দরিয়ানগর, কক্সবাজার পৌছাই। পাহাড়ের গায়ে ঘেষা সুউচ্চ নিরিবিলি কটেজে রাতে ভালোই ঘুম হয় সকলের।
পর দিন সকাল বেলা সবাই পরিপাটি হয়ে আমরা যাত্রা করি, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সাফারি পার্ক, ডুলাহাজরার উদ্দেশ্যে। সাফারি পার্কে বিভিন্ন প্রজাতির প্রাণীর মুক্ত পদ চারণা অবলোকন করে সকলেই এবং অনেক শিক্ষার্থীরা জীবনে প্রথমবারের মতো সরাসরি হাতির দেখা পায় এবং হাতির পিঠে চড়ে এক নতুন অভিজ্ঞতা লাভ করে। তাছাড়া, অ্যানিমেল সাইন্স বিভাগের প্রভাষক ডা. শিরিনা আক্তার তমা অত্যন্ত আন্তরিকতার সাথে,পরিশ্রম করে প্রত্যেক প্রাণীর কাছে গিয়ে তাদের স্বভাব, বাসস্থান, খাদ্যাভ্যাস, এনক্লোজার (খাঁচা) ইত্যাদি সম্পর্কে বাস্তব ধারণা দেন, ফলে শিক্ষার্থীরা চিড়িয়াখানা ও সাফারি পার্কের পার্থক্যের মধ্যে একটা স্বচ্ছ ধারণা পায়। সাফারি পার্ক পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে আমাদের একাডেমিক ট্রিপ সফলতার সাথে শেষ হয়।
এরপর পাঠদানে মনোযোগ বাড়াতে ও মানসিক স্বাস্হ্যের উন্নয়নের লক্ষ্যে রিফ্রেশমেন্টের জন্য সবে মিলে কক্সবাজারের অবিরাম সৌন্দর্য উপভোগে বের হই সেদিন বিকালেই। সারা বিকাল আমরা সবাই কক্সবাজারে কলাতলীর বিচের অপরূপ সৌন্দর্য অবলোকন করি। নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি কক্সবাজার কলাতলী সমুদ্র সৈকত সেদিন এক ঝাক হকৃবিয়ানের উচ্ছ্বাস দেখেছিল। বিকাল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামলে আমরা সূর্যাস্ত দেখি এবং সেদিন হাজারো স্হির চিত্র বন্দি করি যা আমাদের ভবিষ্যতে অনেক গল্পের প্রেক্ষাপট রচনা করবে। রাত নামলে আমরা রাতের সী বিচের সৌন্দর্য উপভোগ করি এবং কলাতলী বিচ ত্যাগ করে লাবণী বিচে গমন করি এবং ঐখানকার ব্যতিক্রমী শ্রীতে মুগ্ধ হই। রাত ১০ টা নাগাদ আমরা বিভিন্ন খোশ গল্প ও গানের আয়োজন করি যার প্রধান পৃষ্ঠপোষক ছিলেন সবার প্রিয় ডা: সালাউদ্দীন স্যার।
এ সময়ে এখনকার আলোচিত
“আমার মন বসে না শহরে,
ইট পাথরের নগরে,
তাইতো আইলাম সাগরে,
তাইতো আইলাম সাগরে।
এই সাগর পাড়ে আইসা আমার মাতাল মাতাল লাগে,” গান টা ব্যাচের সবাই মিলে সুর ধরি যার স্মৃতি স্বরূপ একটা ভিডিও ধারণ করতে ভুল করেন নি ডা. সালাউদ্দীন ইউছুপ স্যার। এভাবে, নানা গানে মুখরিত লাবণী বিচের একপ্রান্তে তখন এ এক দারুণ অভিজ্ঞতা। রাত গভীর হবার আগেই আমরা আমাদের কটেজে ফিরে যাই।
পরের দিন ২ তারিখ অর্থাৎ ট্যুরের শেষদিন আমাদের জন্য ছিল উন্মুক্ত ঘুরাঘুরি। এ দিনে আমরা সবাই মিলে হিমছড়ি ঝর্না এবং কক্সবাজারের সবচেয়ে সুন্দর সী-বিচের একটি ইনানী বিচ ভ্রমণ করি। ইনানী সী বিচে আমাদের সবার জীবনে স্মরণীয় হয়ে থাকার মত সহস্র ঘটনার সৃষ্টি হয়। এদিন শিক্ষক ছাত্র আমরা সবাই আমাদের কৈশোরে ফিরে গিয়েছিলাম ঘন্টাখানেকের জন্য। শিক্ষক শিক্ষার্থী সবাই মিলে এভাবে একসাথে সমুদ্রে গোসল করার স্মৃতি আমাদের জীবনে মরণের আগ পর্যন্ত চিরসবুজ হয়ে থাকবে। উত্তাল সাগরের ঢেউয়ের সাথে যেন মনে হচ্ছিল আমাদের দুঃখ কষ্টগুলো তীরে আছড়ে পড়ছিল। সমুদ্রের ঢেউ সাথে আমরাও দোল খাচ্ছিলাম এটা আমাদের অন্যরকম মানসিক প্রশান্তি দিয়েছিল যেন মনে হচ্ছিল আমরা সমুদ্রকে পড়ছি। সমুদ্রে আমরা সবাই কিছুক্ষণ ভলিভল খেলি এটা দারুণ স্মৃতি ছিল।অতঃপর সময় ফুরিয়ে যাবার আগেই আমরা আবার মেরিন ড্রাইভ হয়ে আমাদের কটেজে ফিরে যাই এবং আমাদের ব্যাগ এন্ড ব্যাগেজ গুছিয়ে আবার রওনা দেই আমাদের পুরানো গন্তব্য সবার প্রিয় হকৃবি’র প্যাভিলিয়নে। ফিরে আসার সময় বার বার আমাদের মনে হচ্ছিল আর কিছুটা সময় যদি অবস্হান করা যেতো কতই না ভালো হতো! আর বার বার সমুদ্রের আস্ফালনের ঢেউ আমাদের হৃদয়ে দাগ কেটেছে যেন মনে হতে লাগলো যদি এই ক্লান্ত পথে হারিয়ে যেতে পারতাম অনন্ত কালের জন্য! আহ! এসব ভাবতে ভাবতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি তার ইয়াত্তা নেই। প্রায় ১০ ঘন্টা ভ্রমণের পর আমরা আমাদের নিজ ক্যাম্পাসে ফিরলাম এবং শিক্ষকদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করে সকাল ১০ টা নাগাদ যার যার বাসস্হানে পৌঁছালাম।
লেখাঃ এ. এস. এম. রুহুল আমিন সাগর,
বি.এস.সি. ইন ভেট. সায়েন্স এন্ড এ.এইচ.(লেভেল-১, সেমিস্টার-২), প্রথম ব্যাচ, এনিমেল সায়েন্স এন্ড ভেটেরিনারি মেডিসিন অনুষদ, হবিগঞ্জ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়।
Leave a Reply