পটুয়াখালীর দুমকিতে সরকারি নিয়মনীতির তোয়াক্কা ছাড়াই ব্যাঙের ছাতার মতো গড়ে উঠেছে ডায়াগনস্টিক সেন্টার। এসব ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোতে প্যাথলজিকাল টেস্টে সরকার নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে পাঁচগুণেরও বেশি আদায় করা হচ্ছে। রয়েছে অদক্ষ ও হাতুড়ে প্যাথলজিস্ট, টেকনেশিয়ান ও এক্সরে টেকনেশিয়নের মাধ্যমে ভুল রিপোর্ট দেয়ার অসংখ্যে অভিযোগ । স্বাস্থ্য সেবার নামে সরকারি নির্দেশনা অগ্রাহ্য করে গড়ে ওঠা অদক্ষ জনবলের এসব ডায়াগনাস্টিক সেন্টার গুলোতে কাঙ্খিত সেবার পরিবর্তে রুগীরা প্রতিনিয়ত হয়রাণী, আর্থিক ক্ষতি এমনকি ভুল চিকিৎসায় মৃত্যুর মুখে পতিত হলেও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না। নীরব জেলা ও উপজেলা স্বাস্থ্য বিভাগ।
জানা গেছে, উপজেলার ৩১শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতালের পঞ্চাশ থেকে ১০০ গজ দূরত্বে ও শহরের বিভিন্ন এলাকায় অন্তত: ৭টি ডায়াগনস্টিক সেন্টার। এর মধ্যে পপুলার, দি প্যাথলজি, মেডিকেয়ার, ফোরসাইট প্যাথলজি, রামিম ডায়াগোনাস্টিক সেন্টার, লুথ্যারাণ হেলথ কেয়ার, মর্ডান ডায়াগনস্টিক সেন্টার অন্যতম। এদের অধিকাংশের সরকারি অনুমোদন নেই। অভিযোগ রয়েছে এসব ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোতে সরকার নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে পাঁচগুণ মূল্যে টেস্ট করা হচ্ছে। অদক্ষ প্যাথলজিস্ট, টেকনেশিয়ান ও এক্সরে টেকনেশিয়ান দিয়ে চলছে কার্যক্রম।
দুমকি উপজেলা হাসপাতালে এক্স-রে মেশিনটি প্রায় দেড় যুগেরও বেশী সময় ধরে অকেজো। নূতন এক্স-রে মেশিন আসলেও তা দু’বছর যাবৎ প্যাকেটবন্ধি পড়ে আছে। প্যাথলজীতেও রয়েছে রিয়েজেন্ট সংকট। এসব অযুহাতে আগত রুগীদের সরকারি ভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা হচ্ছে না। তাই রুগীদের প্রয়োজনীয় পরীক্ষা নিরীক্ষার জন্য প্রাইভেট ক্লিনিক ও প্যাথলজী সেন্টারে যেতে বাধ্য হন। এসুযোগে প্রাইভেট ক্লিনিক ও প্যাথলজী গুলো একরকম গলাকাটা মূল্য আদায় করছেন। সরকারি হাসপাতাল গুলোতে এক্স-রে মূল্য ৮-১০ ইঞ্চি ৫৫ টাকা। একই এক্সরে ডায়াগনস্টিক সেন্টারে ৩৫০ টাকা। সরকারিতে ১৪-১৪ ইঞ্চি এক্সরের মূল্য ৭০টাকা। ওই এক্সরে ডায়াগনস্টিক সেন্টারে নিচ্ছে ৪৫০ টাকা। এভাবেই ডিজিটাল এক্সরে মেশিন বলে পুরাতন মেশিন দিয়ে এক্সরে করে রোগীদের কাছ থেকে হাতিয়ে নিচ্ছে পাঁচগুণ টাকা। সরকারি হাসপাতালে টিসি, ডিসি, ইএসআর ও হিমোগ্লোবিন পরীক্ষার মূল্য ১৫০ টাকা। ওই পরীক্ষায় ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোতে নিচ্ছে ৪০০ টাকা। আর এ টেস্ট সরকারি হাসপাতালে ৬০ টাকা ডায়াগনস্টিকে ৩৫০ টাকা। এইচবিএসএজি টেস্ট সরকারি ১৫০ টাকা, ডায়াগনস্টিকে ৪৫০ টাকা। সরকারি হাসপাতালে প্রসাব পরীক্ষায় বিটি সিটির মূল্য ৩০ টাকা। ডায়াগনস্টিকে ৩০০ টাকা। প্রেগনেন্সি টেস্ট হাসপাতালে ৮০ টাকা ডায়াগনস্টিকে ২৫০ টাকা। আলট্রাসনোগ্রাম প্রকারভেদে ডায়াগনিস্টকে ৪৫০ থেকে ৭০০ টাকা। যা পার্শ্ববর্তী পটুয়াখালী সদর উপজেলা ও পৌরশহরে ২০০টাকা। বিশ্বস্ত সূত্রে জানা গেছে, চিকিৎসকরা টেস্টের নামে ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলো থেকে কমিশন পাচ্ছেন। তাদের সুবিধা নেয়ার কারণেই ডায়াগনস্টিক সেন্টারে টেস্টের মূল্য তালিকায় এমন হেরফের। এ ছাড়া ডায়াগনস্টিক সেন্টারের মালিকরা চিকিৎসকদের সুবিধা নেয়ায় নিজেরা ইচ্ছা মাফিক মূল্য বাড়িয়ে রোগীদের কাছ থেকে হাতিয়ে নিচ্ছে লাখ লাখ টাকা।
উপজেলার মুরাদিয়া গ্রামের বাসিন্দা ফকু হাওলাদারের মেয়ে শিউলী আক্তার অভিযোগ করেন, সম্প্রতি তিনি জ্বরাক্রান্ত হয়ে লুথ্যারাণ হাসপাতালে ডা. অমিতাভ তরফদারের স্মরণাপন্ন হলে তিনি কয়েকটি টেস্ট দেন। তিনি শহরের মেডিকেয়ার ডক্টরর্স চেম্বারে টেস্ট করালে টাইফয়েড ধরা পরে। আব্বাস সিকদার নামের একজন টেকনোলজিষ্টের স্বাক্ষরিত টেস্ট রিপোর্ট অনুসারে চিকিৎসকের দেয়া টাইফয়েটের ইনজেকশন নেয়ায় সুস্থতার বদলে আরও বেশী অসুস্থ হন। বাধ্য হয়ে পটুয়াখালী সেন্ট্রাল হাসপাতালের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ডা. মশিউর রহমানের অধিনে ভর্তি হন। পুণ:টেস্টে টাইফয়েট জীবানু পাওয়া যায়নি। মেডিকেয়ারের টেস্ট রিপোর্টের ভুল চিকিৎসায় তিনি সুস্থ হওয়ার বদলে আরও বেশী অসুস্থ হন এবং এমন ভুল চিকিৎসায় আর্থিক ভাবে ক্ষতিগ্রস্তসহ হয়রানির শিকার হয়েছেন। একই অভিযোগ করেছেন, জলিশা গ্রামের সৈয়দ আনোয়ার হোসেনের ছেলে সৈয়দ আতিকুল ইসলাম। তিনি অভিযোগ করেন, দু’মাস পূর্বে তিনি পপুলার ডায়াগোনাষ্টিক সেন্টারে টেস্ট করাতে গিয়েও অনুরূপ ভুল রিপোর্টে কস্টভোগের পাশাপাশি অন্তত: ৪৭হাজার টাকার আর্থিক ক্ষতির শিকার হয়েছেন। তিনি বলেন, বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ছাড়াই ওইসব প্যাথলজীর অদক্ষ টেকনিশিয়ানরা টেস্ট রিপোর্ট স্বাক্ষর করায় সাধারণ রোগীসহ তাদের পরিবার গুলো ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন।
অভিযোগের বিষয়ে উপজেলার হাসপাতাল সড়কের দি পপুলার ডায়াগনস্টিক সেন্টারের পরিচালক কাম টেকনিশিয়ান মো. জাকির হোসেন হাওলাদার বলেন, সরকারি মূল্য তালিকা আমাদের দেয়নি। আমরা পার্শ্ববর্তি উপজেলা ও জেলা শহরের ডায়াগনস্টিক সেন্টারের মূল্য তালিকা সামঞ্জস্যরেখে টেস্টের টাকা নিচ্ছি। ভুল রিপোর্ট প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, কেউ ভুলের উর্ধে নয়, তবে সবসময় সতর্ক থেকে প্যাথলজিক্যাল টেস্ট ও রিপোর্ট দেয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। উপজেলার ফোরসাইট মেডিকেল এন্ড প্যাথলজি সেন্টারের পরিচালক সৈয়দ মজিবুর রহমান টিটু বলেন, দুমকিতে অধিকাংশ ডায়াগনস্টিক সেন্টারের অনুমোদন নেই। লাইসেন্সের আবেদন করার পর শর্তমতে জনবল দিয়ে সবাই প্যাথলজীর ব্যবসা পরিচালনা করছেন। তবে তার প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজনীয় কাগজপত্র সঠিক আছে বলে দাবি করেন।
উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. মীর শহীদুল হাসান শাহীন ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোতে মূল্য তালিকায় গরমিল, দক্ষজনবল না থাকার সত্যতা স্বীকার করে বলেন, অনুমোদনহীন ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোর ব্যাপারে ব্যবস্থা নিতে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে সুপারিশ করা হয়েছে। উপজেলা হাসপাতালে প্যাথলজীক্যাল টেস্ট না হওয়া প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, একেবারে হয় না কথাটি সঠিক নয়। প্যাথলজীতে কিছু কিছু টেষ্ট করানো হয়, তবে রিয়েজেন্ট সরবরাহ অপ্রতুল হওয়ায় সকল পরীক্ষা করানো সম্ভব হচ্ছে না।
Leave a Reply