“আষাঢ়-শ্রাবণ; ষড়ঋতুর এক প্রকৃতিস্নাত শীতলতার বর্ষাকাল,
গ্রাম-শহর জলে ভরাভর; মানুষের জীবিকা নাজেহাল!
ফুটে কদম-কৃষ্ণচূড়া, গাথে ‘নকশিকাঁথা’-জননীরা গ্রামবাংলার,
বৃষ্টি শেষে রংধনু বরণ; উচ্ছ্বাস সীমাহীন সারাবেলার।”
‘সোনার বাংলার’ ঋতুর পালাবদলে গ্রীষ্মের গন্ডি পেরিয়ে এক চিলতে পশলা বৃষ্টির শীতলতার স্পর্শে; শস্যশ্যামল ও জনজীবন প্রকৃতির দ্বারে কড়া নাড়ছে বারংবার।
গ্রামবাংলার মা, মাটি ও মানুষ বর্ষাকালের প্রকৃতির সবুজ সমারোহে প্রফুল্ল। মেঘের ভেলা ভেসে বেড়ানো ও টিনের চালে পড়া বৃষ্টির ঝুমঝুম শব্দের প্রতিটি মুহূর্ত যেন; হৃদয়ের স্মৃতির অ্যালবাম। বর্ষার প্রান্তে রাতের অন্ধকারে ঝিঁঝি পোকার ডাক, এ যেন শুক্র গ্রহের সন্ধ্যা আকাশের সন্ধ্যা তারার মেলা। ইট-পাথরের রাজ্যের ফাঁকে মেঘের ডাক ও সূর্য মামার মুচকি হাসি: শহুরে জনজীবনকে দেয় স্বপ্ন এবং স্মৃতি চারণের বিশ্বাস ও প্রত্যয়ের হাতছানি।
বর্ষাকালে বৃষ্টিতে নদী-নালা, খাল-বিল ইত্যাদি জলরাশিতে থৈ থৈ করে। এ সময় কৃষকদের মাঠের ফসল সজীবতা ফিরে পায় ও তাদের মুখে হাসি ফুটে। গ্রাম থেকে শহরে ছড়িয়ে পড়ে আড্ডা দেওয়া, ফুটবল খেলা, মুড়ি মাখা খাওয়া, ইলিশ-খিচুড়ি রান্নার আমেজ। এছাড়াও, গ্রাম বাংলার জননীরা আপন নিপুন হাতে গাথে ঐতিহ্যবাহী নকশিকাঁথা। গ্রামে দেখা যায়, মাছ খেলা করে জলরাশিতে ও সন্ধ্যার পর শোনা যায় ব্যাঙের ডাক। যা এই বাংলার বাহিরে- কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবে? এমন অপরূপ সৌন্দর্য্যে! এই আবহাওয়ায় আম, জাম, কাঁঠাল, চালতা, ডেউয়া ইত্যাদি ফলের দর্শন মিলে। এই বর্ষার স্পর্শে ফুটে শাপলা, কদম, কৃষ্ণচূড়া, দোলনচাঁপা ইত্যাদি নানারকমের ফুল। তাই’তো বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বর্ষাকালকে বন্দনা করে “বৃষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর” শিশুতোষ এর জনপ্রিয় ছড়াতে বলেছেন-
‘মনে পড়ে সুয়োরানী দুয়োরানীর কথা/ মনে পড়ে অভিমানী কঙ্কাবতীর ব্যথা/… তারি সঙ্গে মনে পড়ে মেঘলা দিনের গান/ বিষ্টি পড়ে টাপুর-টুপুর, নদেয় এলো বান।’
বাংলার এই বর্ষাকাল ঋতুকে নিয়ে রূপসী বাংলার কবি জীবনানন্দ দাশ, পল্লী কবি জসিম উদ্দিনসহ অনেকে সাহিত্যের মাধুর্য দিয়ে কবিতা, গল্প ইত্যাদি লিখেছেন।
প্রকৃতপক্ষে, জনজীবনে বর্ষাকালকে ঘিরে আনন্দ-উচ্ছ্বাস ও প্রকৃতি প্রেম থাকলেও সাধারণ মানুষের কাছে এক নিরাশার প্রতিচ্ছবি। আষাঢ়-শ্রাবণ এই দুই মাস বর্ষাকাল হলেও, আশ্বিন মাস পর্যন্ত এর স্থায়ীত্ব অনেকটা থাকে। ফলে, নিচু জমি এবং উপকূলীয় অঞ্চলে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়ে কৃষকদের ফসল উৎপাদন কমে যায়। এছাড়াও, বন্যার কারণে মৎস্য চাষীর মাছ ভেসে যায়; তাঁরা মানসিকভাবে ভেঙে পড়ে। মেহনতি মানুষেরা ঘরের বাহিরে যেতে না পারায়: অর্থ উপার্জন করতে পারে না; যার ফলে তাদের কপালে চিন্তার ভাঁজ জমা হয়। গ্রামীণ রাস্তা-ঘাট কাঁদা হয়ে যায়, ঘড়-বাড়ি তলিয়ে যায়, গৃহপালিত পশু-পাখির আবাসস্থল ব্যবহারের অযোগ্য হয়ে পড়ে ইত্যাদি কারণে সাধারণ মানুষের জীবন বিভীষিকাময় হয়ে পড়ে। শহুরে রাস্তায় জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হওয়ায়, গাড়ি ও মানুষের চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়ে। তাই বর্ষাকাল করো জীবনে বসন্তের ছোঁয়া হলেও অন্য কারো জীবনে এক হতাশা ও দুশ্চিন্তার জাল।
মানবিক মানুষ ও সচেতন নাগরিক হিসেবে আমাদের উচিত- নিজেদের বর্ষা বিলাসের আন্দনকে গন্ডির ভিতর রেখে, অসহায় মানুষদের পাশে দাঁড়ানো। এছাড়া, সরকারি এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগে বর্ষাকালে যে সকল পানি বাহিত রোগ সৃষ্টি হয়; সেই বিষয়ে গ্রামীণ জীবন থেকে শুরু করে শহুরে পর্যায় পর্যন্ত রোগের কারণ, লক্ষণ, প্রতিকারের উপায় ইত্যাদি সম্পর্কে বিভিন্ন সেমিনার, সংবাদপত্র, মিডিয়াতে তুলে ধরে- মানুষদের স্বাস্থ্য সচেতন ও পদক্ষেপ গ্রহণে অনুপ্রাণিত করা। আমার উদার্থ আহ্বান ও অনুরোধ থাকবে কোমল হৃদয়ের প্রকৃতি প্রেমীদের কাছে- তাঁরা এই ঋতুর প্রতি ভালোবাসা, উচ্ছ্বাস ও গ্রামীণ জীবনের ঐতিহ্য যেনো অটুট রাখে এবং খেটে খাওয়া মানুষের সুখে-দুঃখের সাথী হওয়ার উদার মন প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়।
লেখক,
সুমন দাস
সাবেক শিক্ষার্থী,
রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ,
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, গোপালগঞ্জ।
Leave a Reply