মিত্র যদি ভাবো পরিবেশকে, টিকে থাকবে তবেই এই ধরণীতে
প্রোটোজোয়া থেকে স্তন্যপায়ী প্রাণী, উদ্ভিদ, ঘাসের ফলক থেকে নিখরচায় ফুল, মাশরুম, বিভিন্ন অণুজীব যেমন ভাইরাস এবং ব্যাকটেরিয়া পর্যন্ত প্রতিটি প্রাণী পরস্পরের ওপর নির্ভরশীল, এই বাস্তুতন্ত্রে প্রতিটি প্রজাতি যেনো একই বিনি সুতোয় গাঁথা!
১৯৭৪ সাল থেকে প্রতি বছর জুন মাসের পঞ্চম দিনে বিশ্বব্যাপী জনসচেতনতার মাধ্যমে পরিবেশ সচেতনতার লক্ষ্যে পালিত হয় বিশ্ব পরিবেশ দিবস।
বিশ্ব পরিবেশ দিবসের এ বছরের প্রতিপাদ্য – ইকোসিস্টেম পুনরুদ্ধার(Ecosystem Restoration)।
জাতিসংঘে আজ থেকে ইকোসিস্টেম পুনরুদ্ধারের জন্য নতুন দশকের সূচনা হতে যাচ্ছে।
বিশ্বে প্রতিটি জীবই কোনো না কোনোভাবে পরিবেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। তাই জীবজগতের ভারসাম্য বজায় রাখা ও পরিবেশের সুরক্ষার স্বার্থে সব জীবকেই বাঁচতে দিতে হবে। এক্ষেত্রে উদ্ভিদের ভূমিকা নিয়ে আমরা সন্দেহাতীত কারণ কার্বন ডাই অক্সাইড শোষণ এবং অক্সিজেন উৎপাদনের মধ্যে তার কার্যক্রম নিহিত। আলোক সংশ্লেষণের জন্য এই বৃক্ষরাজি কে ধন্যবাদ জানাই। যা ছাড়া প্রাণী এবং মানুষের অস্তিত্ব অসম্ভব।
তাছাড়া বৈচিত্র্যময় উদ্ভিদ ও অবিচ্ছিন্ন প্রাণী (পোকামাকড়, কৃমি ইত্যাদি) মাটি গঠনে সক্ষম, পৃথিবীর পৃষ্ঠের পানির পরিমাণ এবং বিভিন্ন ধরণের জলবায়ুর সৃষ্টি তাদের উপর নির্ভর করে। পরিবেশে অক্সিজেনের সরবরাহ বজায় রাখতে, বৃষ্টিপাত ঘটাতে উদ্ভিদের ভূমিকা অপরিহার্য। মানব জীবনে উচ্চ ক্যালরি, প্রোটিন, ভিটামিন সমৃদ্ধ খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, ওষুধপত্র প্রভৃতির জন্য সরাসরি প্রকৃতির ওপর নির্ভরশীল জীববৈচিত্র্যের জন্যই মানুষ তার ক্রমবর্ধমান খাদ্য চাহিদা প্রকৃতি থেকে মেটাতে সক্ষম হয়। মানুষ বৈচিত্র্যময় উদ্ভিদ ও প্রাণী থেকে কেবল খাদ্যসামগ্রী পায় তাই নয়; ঔষধ, কাঠ, কাগজ, তন্তু, রাবার, ট্যানিন, ফুলফল ইত্যাদিও পায়।
বিভিন্ন প্রজাতি থেকে মাছ মাংস, দুগ্ধ সামগ্রী, চামড়া, পালক, উল, লাক্ষা, প্রাণী (মৌমাছি, পাখি ইত্যাদি) ফুলের পরাগায়ণ এবং ঘাস এবং গাছের বীজের বিস্তার ঘটাতে অংশ নেয়। উদ্ভিদের সংখ্যা গবাদি পশুর দ্বারাই নিয়ন্ত্রিত হয়। আবার বিভিন্ন জীবাণুর নিয়ন্ত্রিত ব্যবহারের মাধ্যমেও বিভিন্ন শিল্পসামগ্রী উৎপাদন করা যায়। এক কথায় খাদ্য ও স্বাস্থ্য রক্ষার জন্য মানুষ জীববৈচিত্র্যের ওপর প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে নির্ভরশীল। জীববৈচিত্র্য হলো প্রকৃতপক্ষে বিপুলসংখ্যক জিনের ভাণ্ডার। জৈবপ্রযুক্তির মাধ্যমে যা সংগ্রহ করে অর্থনৈতিক গুরুত্ব সম্পন্ন উদ্ভিদ ও প্রাণীতে স্থানান্তরিত করে পছন্দসই গুণসম্পন্ন উচ্চফলনশীল ট্রান্সজেনিক উদ্ভিদ ও প্রাণী তৈরি করা সম্ভব হয়েছে যেখানে ভেটেরিনারিয়ানরা একযোগে কাজ করে গেছেন।
কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে, জনসংখ্যার উচ্চহারের সঙ্গে উচ্চ ফলনের জোগানের জন্য ইকোসিস্টেম ধ্বংস হচ্ছে। কোনো কারণে পরিবেশের উপাদান- পানি, বায়ু এবং মাটির স্বাভাবিক দূষণ ঘটে। শিল্পের কাঁচামাল সংগ্রহ এবং বৈজ্ঞানিক গবেষণার জন্যে অত্যধিক হারে উদ্ভিদ ও প্রাণীর নমুনা সংগ্রহ করা হয়। এভাবে বাস্তুতন্ত্র ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
কৃষিকাজ, গৃহায়ন, রাস্তা ও বাঁধ নির্মাণ, শিল্পকারখানার প্রসার, বালি-পাথর দিয়ে ভরাট, চাষাবাদের জন্য নিম্ন জলাভূমি ভরাট, পর্যটন ইত্যাদি উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা যায়। আমদানি করা প্রাণী ও আগাছা ইকোসিস্টেমের ওপর ভয়াবহ প্রভাব সৃষ্টি করে। এরা জীব সম্প্রদায়ের গঠন, বায়োজিওকেমিস্ট্রি, ভূমি ক্ষয়, পানি চক্র ইত্যাদি দ্বারা মাটির পানি ধারণক্ষমতা, প্রাণীর চারণ, ক্ষুদ্র প্রাণী কর্তৃক তৃণচারণ, রোগ সৃষ্টি, মিথোজীবী ক্রিয়া সংঘটনে সহায়তা করে। এর ফলে স্থানীয় উদ্ভিদ ও প্রাণিপ্রজাতির ওপর প্রবর্তিত প্রাণী ও উদ্ভিদ ভয়াবহ ক্ষতিকর প্রভাব বিস্তার করে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ইউক্যালিপটাস, কচুরিপানা, আফ্রিকান মাগুর, পিরানহা প্রভৃতি প্রবর্তিত উদ্ভিদ ও প্রাণী উদাহরণ।
তাছাড়া, বর্তমানে কিছু অসাধু মানুষ ক্ষুদ্র ও সাময়িক স্বার্থে কারেন্ট জাল ও নেট জাল ইত্যাদি ব্যবহার করে মাছ ও পাখি নিধন করছে। এক গবেষণায় দেখা গেছে, ১৯৭০ সালের পর থেকে স্বাধু পানির স্তন্যপায়ী প্রাণী, পাখি, উভচর প্রাণী, সরীসৃপ এবং মাছের সংখ্যা প্রায় ৪ শতাংশ হারে হ্রাস পেয়েছে। যা জলবায়ু পরিবর্তন ও জীববৈচিত্র ক্ষয় হওয়ার জন্য দায়ী। যার ফলস্বরুপ, কোভিড -১৯ এর মতো জুনেটিক (অন্য প্রাণী থেকে মানুষের শরীরে আসা সংক্রামক ব্যাধি) রোগের ঝুঁকি বাড়ছে।
তবে আশার কথা এই যে, যেখানে পুরো বিশ্ব ব্যস্ত করোনায় আক্রান্ত ও মারা যাওয়া মানুষের হিসাব নিয়ে, সেখানে প্রকৃতি যেন তার উল্টো হিসাবে ব্যস্ত! সে যেন বিন্দুমাত্র উদ্বিগ্ন নয়। মনুষ্য তাণ্ডবের আড়ালে আবডালেই চলছে তার হঠাৎ জাগরণের খেলা। নীরব, নির্জন, কোলাহলমুক্ত পরিবেশে প্রকৃতি নিজের সুষমা, সৌন্দর্যরাশি যেন একের পর এক তুলে ধরছে। লকডাউনের জন্য প্রবেশের ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে সব পর্যটনকেন্দ্রে। কোলাহলপূর্ণ সৈকত যেন আজ হাঁপ ছেড়ে বেঁচেছে। সৈকত রাজ্যের এ সুনসান নীরবতায় সবুজ গালিচা তৈরিতে মাতোয়ারা হয়ে উঠেছে সাগরলতা, সবুজ এ জালের মধ্যে ফুটছে অগণিত জাতের নাম জানা না-জানা বাহারি রঙের সব ফুল, বিনা বাধায় সমুদ্রের বিশাল বালুকা বেলাভূমিতে ঘুরে বেড়াচ্ছে কচ্ছপের দল। ইতিমধ্যে ডিম পাড়াও শুরু করেছে তারা। বিপন্ন প্রজাতির তালিকায় থাকা সামুদ্রিক এ কচ্ছপ সামুদ্রিক পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায়, বিশেষ করে খাদ্যশৃঙ্খল বজায় রাখছে। অন্যদিকে বহু বছর পর লোকালয়ের একদম কাছে এসে ডিগবাজিতে মেতেছে ডলফিনের দল।
ধরণীর এই ক্রান্তিলগ্নেও প্রকৃতির মনোমুগ্ধকর নৃত্য যেন অপার মহিমাভরা পরিবেশ-প্রকৃতির বাস্তুতান্ত্রিক জাগরণে মেতে ওঠার প্রমাণিক দলিলই ফুটে উঠেছে।
আর তাই, ধরণীর বুকে প্রাণের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে সবাই একযোগে কাজ করবে সেই আশাবাদ ব্যক্ত করছি।
লেখকঃ মুবাশ্বিরা নাজিয়াহ্ মেধা।
শিক্ষার্থী, লাইভস্টক সাইন্স এন্ড ভেটেরিনারি মেডিসিন বিভাগ। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, গোপালগঞ্জ।
Leave a Reply