জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীন বাংলাদেশের মহান স্থপতি, একটি নতুন মানচিত্রের অমর রূপকার। বঙ্গবন্ধু ছিলেন উদার চেতনার অধিকারী একজন মুসলমান। বঙ্গবন্ধুর পূর্ব পুরুষ শেখ আউয়াল ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্যে হযরত বায়জিদ বোস্তামী (রা.) এর শিষ্যত্ব গ্রহণ করে তাঁর সাথে ভারতীয় উপমহাদেশে আসেন প্রথম। পরবর্তীতে তারই উত্তর পুরুষেরা বর্তমান গোপালগঞ্জ জেলার টুঙ্গিপাড়ায় বসতি স্থাপন করেন। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু হচ্ছেন ইসলাম প্রচারক শেখ আউয়ালের সপ্তম বংশধর। বঙ্গবন্ধুর পিতা শেখ লুৎফর রহমান ছিলেন একজন ধর্মপ্রাণ মুসলমান ও ইসলামের প্রচার ও প্রসারের নিবেদিত মানুষ। বাংলাদেশকে সকল ধর্মের সকল মানুষের জন্য শান্তির দেশ হিসেবে গড়ে তুলতে তিনি ছিলেন সদা সচেষ্ট। তিনি তাঁর সংক্ষিপ্ত শাসনকালে ইসলামের প্রচার ও প্রসারে যে অসামান্য অবদান রেখেছেন তা মুসলিম বিশ্বে বিরল।
টঙ্গীতে বিশ্ব ইজতেমার স্থান বরাদ্দ
বিশ্ব ইজতেমা শান্তিপূর্ণভাবে পালন করার জন্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সর্বপ্রথম স্থায়ী বন্দোবস্ত হিসেবে তুরাগ নদীর তীরবর্তী জায়গাটি প্রদান করেন। সে হতে অদ্যাবধি তাবলিগ জামাত ওই স্থানে বিশ্ব ইজতেমা পালন করে আসছে। টঙ্গীতে বঙ্গবন্ধু এই স্থান বরাদ্দের বদৌলতেই বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের লক্ষ লক্ষ মুসলিম এখানে সমবেত হয়ে ইসলামের দ্বিতীয় বৃহৎ সম্মেলন করে যাচ্ছেন। এছাড়া তাবলিগ জামাতের কেন্দ্রীয় মারকাজ নামে পরিচিত কাকরাইল মসজিদের সম্প্রসারণের দরকার হলে তখন রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে বঙ্গবন্ধু নির্দ্বিধায় কাকরাইল মসজিদকে সরকারি জায়গা বরাদ্দ দিয়ে এর সম্প্রসারণের ব্যবস্থা করে দেন।১৯৭২ সাল থেকে বর্তমান অবধি ‘বিশ্ব ইজতেমা’ টঙ্গীর তুরাগ নদের উত্তর-পূর্ব তীরসংলগ্ন ডোবা-নালা, উঁচু-নিচু মিলিয়ে ১৬০ একর (এখন প্রায় ১৭৫ একর) জায়গার বিশাল খোলা মাঠে অনুষ্ঠিত হচ্ছে। প্রতিবছর বাংলাদেশের প্রত্যন্ত গ্রাম-শহর-বন্দর থেকে লাখ লাখ ধর্মপ্রাণ মুসলমান এবং বিশ্বের প্রায় ১০০ থেকে ১২০টি দেশের তাবলিগি দ্বীনদার মুসলমান জামাতসহ ৪০ লক্ষাধিক মুসল্লি বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম ইসলামি মহাসম্মেলন বা বিশ্ব ইজতেমায় অংশ নেন।
১৯২৭ খ্রিষ্টাব্দে মাওলানা ইলিয়াস [রহ.] ভারতের উত্তর প্রদেশের সাহরানপুর এলাকায় ইসলামী দাওয়াত তথা তাবলিগের প্রবর্তন করেন এবং একই সঙ্গে এলাকাভিত্তিক সম্মিলন বা ইজতেমারও আয়োজন করেন। বাংলাদেশে ১৯৫০-এর দশকে তাবলিগ জামাতের প্রচলন করেন মাওলানা আবদুল আজিজ। বাংলাদেশে তাবলিগ জামাতের কেন্দ্রীয় মারকাজ বা প্রধান কেন্দ্র কাকরাইল মসজিদ থেকে এই সমাবেশ কেন্দ্রীয়ভাবে পরিচালনা করা হয়।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনায় নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার
ইজতেমার নিরাপত্তায় পাঁচস্তরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। সাদা পোশাকে পুলিশ, টহল পুলিশ, ওয়াচ টাওয়ার থেকে পর্যবেক্ষণ করা হয়, র্যাবের পাশাপাশি পুলিশেরও স্ট্রাইকিং ফোর্স থাকে। দুর্ঘটনা ও ভিআইপি বহনের জন্য ৩টি হেলিপ্যাড প্রস্তুত রয়েছে। ইজতেমার নিরাপত্তায় প্রায় সাড়ে ১০ হাজারের মতো নিরাপত্তা কর্মী দায়িত্ব পালন করছেন। এতোসব আয়োজন ও আনুষ্ঠানিকতা শুধু আল্লাহর ভালোবাসা ও নৈকট্য লাভের জন্য। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সূত্রে জানা গেছে, তিন দিনব্যাপী বিশ্ব-ইজতেমার (প্রথম পর্ব) উপলক্ষে টঙ্গীতে নিরাপত্তা বলয় গড়ে তোলার পাশাপাশি সার্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণের ব্যবস্থাও গ্রহণ করেছে আইন শৃঙ্খলা বাহিনী।পুরো ইজতেমা ময়দানকে তিনটি সেক্টরে ভাগ করে আগত লাখ লাখ মুসল্লিদের নিরাপত্তার লক্ষ্যে ইজতেমার ময়দানসহ আশপাশের এলাকায় অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। ইজতেমা মাঠের সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে আজ বৃহস্পতিবার ইজতেমার ময়দাদানের ভিতরে থেকে ৫ হাজার ৩০ জন পুলিশসহ র্যাব, সাদা পোশাকধারী বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার সদস্য ও আনসার সদস্যদের মোতায়েন করা হয়েছে।এছাড়া মুসল্লিদের নিরাপত্তার প্রয়োজনে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) সদস্যরাও প্রস্তুত থাকবে। নিরাপত্তা জোরদার করতে র্যাবের কমিউনিকেশন উইং, পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থার পক্ষ থেকে ১৯টি প্রবেশপথসহ চারপাশের গুরুত্বপূর্ণ স্থানে তিন শতাধিক ক্লোজসার্কিট ক্যামেরা বসানো হয়েছে।এছাড়াও থাকছে মেটাল ডিটেক্টর, নাইটভিশন গগল্স, বাইনোকুলার, বোম্ব ডিসপোজাল টিম, এন্টিটেরোরিজম ইউনিট, হেলিকপ্টার-নৌ টহল, কুইক রেসপন্স টিম (কিউআরটি), ফরেনসিক টিম, সাইবার পেট্রোলিং, ডুবুরি দল, স্টাইকিং ফোর্স, এলআইসি, পিএইচকিউ, এপিসি, জলকামান।এর পাশাপাশি যে কোনো ধরনের অপ্রীতিকর পরিস্থিতি মোকাবেলায় র্যাবের ইন্টেলিজেন্সের সদস্যরা পুরো ময়দান জুড়ে কড়া নজরদারি করছেন। প্রতিটি খিত্তায় বিশেষ টুপি পরিহিত ও সাদা পোশাকধারী গোয়েন্দা সদস্যরা অবস্থান করবেন। তারা কোনো প্রকার সন্ত্রাসী তৎপরতার ইঙ্গিত পেলে বিশেষ সংকেতের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের তৎক্ষণিক অবহিত করবেন। আকাশপথ, স্থলপথ, নৌপথ ও রেলপথ কঠোর নজরধারীর আওতায় থাকবে। আকাশ পথে টহল দিবে র্যাবের হেলিকপ্টার।এদিকে, জিএমপি কমিশনার জানান, ইজতেমার সার্বিক নিরাপত্তায় পর্যাপ্ত পুলিশ মোতায়েন থাকবে। সিসিটিভি ক্যামেরা, ওয়াচ টাওয়ার ও রুফটপ থেকে পুরো ইজতেমা ময়দানের নিরাপত্তা পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। তুরাগে নৌ টহল থাকবে।তিনি আরও জানান, বিশ্বইজতেমা ময়দান ও আশপাশে ২২টি নিয়ন্ত্রণ কক্ষ রয়েছে পুলিশের। এ ছাড়া ডগ স্কোয়াড টিম, মোবাইল পেট্রোল টিম, বোম ডিসপোজল টিম থাকবে।
“দি লাইফ সেভিং ফোর্স বাহিনী”
অগ্নিনির্বাপণের জন্য প্রতি খিত্তায় এবার দু’টি করে অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্র রাখা হবে। এদিকে, ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের মহাপরিচালক উদ্ধৃতি দিয়ে “দি লাইফ সেভিং ফোর্স বাহিনী” ঢাকা জোন-৩ এর উপ-সহকারি পরিচালক এবং টঙ্গীর বিশ্ব ইজতেমা মাঠের দায়িত্বরত কর্মকর্তা জানান, এবারের বিশ্ব ইজতেমা সফল ও স্বার্থক করার লক্ষে টঙ্গী তুরাগ নদীর সুবিশাল ইজতেমা ময়দানকে ফায়ার সার্ভিসের ওয়্যারলেস ফ্রিকোয়েন্সির আওতায় আনা হয়েছে।অগ্নি দুর্ঘটনা মোকাবেলায় ময়দানের প্রতিটি খিত্তায় ফায়ার এক্সটিংগুইসার, ফায়ার হুক, ফায়ার বিটারসহ দু’জন করে ফায়ার ফাইটার দায়িত্ব পালন করবেন। টঙ্গীর তুরাগ নদীসহ ময়দানের চারপাশে ১৮ টি পোর্টেবল পাম্প প্রস্তুত রাখা হয়েছে। এছাড়াও ময়দানের বিভিন্ন স্থানে ১০টি পানিবাহী গাড়ি, রোগী পরিবহনে ১৫টি এ্যাম্বুলেন্স, সহজে বহনযোগ্য স্পীড বোট, পিকআপে ডুবুরীদল, বেশ কয়েকটি টু হইলার, ২৩ টি জেনারেটর এবং লাইটিং ইউনিট মোতায়েন থাকবে।ময়দানে ফায়ার কন্ট্রোল রুম স্থাপন করা হয়েছে। এছাড়াও টঙ্গী, উত্তরা ও জয়দেবপুর ফায়ার স্টেশনগুলো স্ট্যান্ডবাই রাখা হয়েছে।
চিকিৎসক, কর্মকর্তা, কর্মচারিদের ছুটি বাতিল
এদিকে বিশ্ব ইজতেমাকে সামনে রেখে টঙ্গী সরকারি হাসপাতাল ও টঙ্গী আহসান উল্লাহ মাস্টার জেনারেল হাসপাতালে কর্মরত সকল চিকিৎসক, কর্মকর্তা ও কর্মচারিদের সকল ধরনের ছুটি বাতিল করা হয়েছে। স্বাস্থ্য বিভাগের নির্দেশনা ও সিদ্ধান্ত মোতাবেক আগামী ১২ জানুয়ারি থেকে ২৩ জানুয়ারি পর্যন্ত সকল ধরনের ছুটি বাতিল করা হয়েছে।
গ্যাস সংযোগ
ইজতেমা ময়দানের উত্তর-পশ্চিম কোণে বিদেশি মেহমানদের জন্য নির্ধারিত কামরার পাশে ১৪০ থেকে ১৫০ পিএসআই উচ্চচাপ সম্পন্ন গ্যাসের লাইন সংযোগ দেয়া হয়েছে। সেখানো শুধু বিদেশি মেহমানদের রান্না বান্নার কাজ হয়ে থাকে।
সড়ক বাতি ও এলইডি লাইট স্থাপন
ময়দানে আগত ধর্মপ্রাণ মুসল্লিদের শুভেচ্ছা জানিয়ে সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে তোরণ নির্মাণের পাশাপাশি টঙ্গী-কামারপাড়া রোডে রঙ বেরঙের সড়ক বাতি লাগানো হয়েছে। এছাড়াও ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে চলমান বিআরটি প্রকল্পের কাজের কারণে মুসল্লিদের চলাচলে যাতে ব্যাঘাত না ঘটে সেজন্য মহাসড়কের বিভিন্নস্থানে চারশ’ এলইডি লাইট স্থাপন করা হচ্ছে।
ময়দানে সুপেয় পানির ব্যবস্থা
ময়দানে আগত মুসল্লিদের ওজু গোসলসহ অন্যান্য কাজে প্রতিদিন প্রায় সাড়ে ৪ কোটি লিটার পানির প্রয়োজন হয়। সেজন্য পূর্বের স্থাপন করা ১৪টি গভীর নলকূপের পাশাপাশি এবার জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে ময়দানে নতুন করে ১হাজার ফুট গভীর ২টি নলকূপ স্থাপন করা হয়েছে।
অস্থায়ী দোকানপাট ও অবৈধ বস্তি উচ্ছেদ
ইজতেমা উপলক্ষে ময়দানের চারপাশের অবৈধভাবে গড়ে তোলা দোকানপাট ও বস্তি ইতিমধ্যে উচ্ছেদ করা হয়েছে। এছাড়াও ময়দানের চারপাশে দেয়াল ও রাস্তার মোড়ে লাগানো অশ্লীল পোস্টার-ব্যানার, সাইনবোর্ড অপসারণ করা হয়েছে।
ইজতেমায় ট্রেন ও বাস সার্ভিস
ইজতেমা উপলক্ষে বিশেষ ট্রেন চলাচলের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। ঢাকা-টঙ্গী, ময়মনসিংহ-টঙ্গী ও টাঙ্গাইল-টঙ্গী রুটে ১৩টি অতিরিক্ত ট্রেন পরিচালিত হবে। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন টঙ্গী রেলওয়ে স্টেশন মাস্টার রাকিবুর রহমান। তিনি আরও বলেন শুক্রবার জুমার দিন স্পেশাল ট্রেন চলাচল করবে। এই রুটে চলাচলরত প্রতিটি ট্রেন ইজতেমা চলাকালীন সময়ে টঙ্গী রেলওয়ে জংশনে যাত্রা বিরতি করবে।
এছাড়াও ইজতেমা উপলক্ষে ১২ জানুয়ারি থেকে ১৬ জানুয়ারি পর্যন্ত ৫দিন বিআরটিসি’র পক্ষ থেকে ৩শ’টি বিশেষ বাস চালু থাকবে। প্রগতিসরনি, আশুলিয়া বাইপাস এবং গাজীপুর চৌরাস্তা থেকে বিমানবন্দর পর্যন্ত সাটল বাস চালু থাকবে। আখেরী মোনাজাতের পর মুসল্লিদের বিভিন্ন জেলায় পৌছে দেয়ার জন্য একতলা বিশেষ বাস পরিষেবা চালু থাকবে। বিদেশি মেহমানদের জন্য একটি স্টীকারযুক্ত এসি বাস বিমানবন্দর থেকে ইজতেমা ময়দান পর্যন্ত নিয়মিত চলাচল করবে।উল্লেখ্য, ১৩ জানুয়ারি শুরু হয়ে ১৫ জানুয়ারি রোববার আখেরি মোনাজাতের মধ্যদিয়ে প্রথমপর্বের (আলমি শূরার) বিশ্ব ইজতেমার সমাপ্তি ঘটবে।
লেখক
আবুল বাশার রিপন খলিফা
সহযোগী অধ্যাপক
ফার্মেসি বিভাগ
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
গোপালগঞ্জ-৮১০০।
Leave a Reply