যেখানে শেষ, সেখান থেকেই নতুন কিছুর শুরু ৷ তবুও শেষটা কাঁদিয়ে যায়, শেষবেলাটা সবার হৃদয়কে আবেগাপ্লুত করে তোলে। বেদনার নীল রঙে আচ্ছাদিত করে তোলে প্রাণ। শেষবেলাটা তাই রঙিন করে তুলতে কালার ফেস্টের আয়োজন। ফ্ল্যাশমবের দারুন ছন্দের শেষেজ যেন আবিরের দমকা হাওয়া শিক্ষার্থীদের রাঙিয়ে তুললো। কিছু বোঝার আগেই ছেলেদের গায়ের টি-শার্টটি উধাও হয়ে গেল। যেন বছরের তৃতীয় ঈদ নেমে এসেছে নোবিপ্রবি’র বুকে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা বিভাগের ১৩ তম ব্যাচের বিদায় উপলক্ষে ১-২ ফেব্রুয়ারী ২ দিনব্যাপী র্যাগ ডের (শিক্ষা সমাপনী) আয়োজন করে একই বিভাগের ১৪ ব্যাচের শিক্ষার্থীরা।
নিজেদের শেষ বেলায় নীড়ে ফেরা পাখি হয়ে নতুনদের জায়গা করে দিতেই র্যাগ ডে’র নাম ‘প্রারব্ধ’ দেয় আয়োজক ব্যাচ। সাথে ‘ভাইয়ে কড়া’ ট্যাগলাইনে র্যাগ ডের পুরো সময়টা জুড়েই ক্যাম্পাস মাতিয়ে রাখা। কাউন্টডাউন, পোস্টারিং, শিক্ষার্থীদের নাচ- গানের প্র্যাক্টিস, গ্রাফিতি অঙ্কন, ডেকোরেশন, টি-শার্ট এতকিছুর মাঝে ঈদ ঈদ আমেজ আসতে বাধ্য।
বিদায়ের পূর্ব মুহূর্তগুলোকে মনের পর্দায় অমলিন করে রাখতে প্রারন্ধের নানা আয়োজন। বিদায়ী ব্যাচের শিক্ষার্থীদের ভাষায়, ‘নানা রঙের নানা মানুষগুলো মিলে একদিন তৈরি হয়ে যায় একটা ব্যাচ। সেই নানা রঙে সাড়ম্বরের সাথে তৈরি হওয়া ব্যাচ, হাজারো গল্প-স্মৃতি সংকলনের মাধ্যমে কী করে যেন একটা নতুন অস্তিত্ব হয়ে যায়। আর জমানো সব গল্পকে স্মৃতিপটে ধারণ করে বেলা শেষে বিদায়ের প্রস্তুতি নিতে হয়।’
কালারফেস্টের দিন সকালে বিদায়ী ব্যাচের শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় খেলার মাঠে হাজির। এর কিছুক্ষণ পরেই দেওয়া হয় সাদা টি- শার্ট। একটু পরেই যে টি-শার্টের আর অস্তিত্ব পাওয়া যাবে না। শুধু র্যাগ ব্যাচই নয়, ক্যাম্পাসের জুনিয়র ব্যাচের শিক্ষার্থীরাও হাজির সিনিয়র ভাই-আপুদের এই উৎসবে নিজেকে রাঙিয়ে নিতে। অল্প কিছুক্ষন পরেই শুরু হয়ে যায় ‘কালার ফেস্ট’। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাঙ্গন সাজে হরেক রকমের রঙের মেলায়। আবিরে মাখামাখি একেকজন। হাজার পাওয়ারের রঙের ছোপ যেন বার বার মনে করিয়ে দিতে চায় চারটি বছরের স্মৃতিগুলো, যা চাইলেই মুছে ফেলা সম্ভব নয়। অনেকে মিলে একজনকে ঘাড়ে করে তুলে নিয়ে যেতে দেখা যায়। কিছুক্ষণ পরই তাকে আবিষ্কার করা হয় মাটিতে লুটোপুটি খেতে। এর সাথে ডিজে, হেড ব্যাং আর নাচানাচি তো আছেই।
দ্বিতীয় দিন, ‘প্রারব্ধ’ এর শুরু হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের হাজী মোহাম্মদ ইদ্রিস অডিটোরিয়ামে শিক্ষা সমাপনী উপলক্ষে আলোচনা সভার মাধ্যমে। প্রধান অতিথি হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. দিদার-উল-আলম শিক্ষার্থীদের জীবন গঠনের দিক তুলে ধরে নির্দেশনামূলক বক্তব্য দেন। এসময় র্যাগ ব্যাচের সবার হাতে ক্রেস্ট তুলে দেয়া হয়। অনুষ্ঠানে আরও উপস্থিত ছিলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ও শিক্ষা বিজ্ঞান অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. নেওয়াজ মোহাম্মদ বাহাদুর, শিক্ষা বিভাগের চেয়ারম্যান সহযোগী অধ্যাপক ড. বিপ্লব মল্লিক, সহকারী অধ্যাপক ওয়ালিউর রহমান আকন্দ, সহকারী অধ্যাপক নওরীন ইয়াসমিন, সহকারী অধ্যাপক ফাতেমা বেগম পপি, সহকারী অধ্যাপক সৈয়দ মো. সিয়াম প্রমুখ।
দুপুরে খাবারের পর্ব শেষে বিকেল থেকে অডিটোরিয়ামে শুরু হয় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। সিটি, প্রেজেন্টেশন, এসাইনমেন্ট, সেমিস্টার ফাইনালকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে বিকেল হতেই একে একে জড়ো হতে থাকে সবাই ক্যম্পাসের অডিটোরিয়াম প্রাঙ্গণে। পুরো অডিটোরিয়াম প্রাঙ্গন লোকে লোকারণ্য। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান শেষে রাত ১০.৩০ টায় মঞ্চে ওঠে বিশ্ববিদ্যালয়ের জনপ্রিয় ব্যান্ড সঙ্গীতের দল ‘ভয়েজার’।
দর্শক-শ্রোতা যেন উল্লাসে ফেটে পড়বে। একে একে ভয়েজারের ভোকাল সজল ভাই বিভিন্ন জনপ্রিয় ব্যান্ডের গান গেয়ে দর্শক মাতালেন। হেড ব্যাং দিতে দিতে সবার অবস্থা শোচনীয়, তবু থামার নাম নেই। সজল ভাইয়ের কভার করা পুরনো সেই দিনের কথা, ওল্ড স্কুল, পূর্ণতা প্রভৃতি গানে দর্শক যখন মাতোয়ারা অডিটোরিয়ামে তখন রঙিন আলোয় আলোকিত করে দিয়ে চলছে আলোকপ্রদর্শনী। ড্রাম, গীটার, কী-বোর্ডের সুরতাল, রঙ-বেরঙের আলোর খেলায় সবার হারিয়ে যাওয়ার মতো আত্মহারা হবার উপক্রম।
আর সবকিছুর মতো ধীরে ধীরে এ উৎসবেরও বেলা শেষ হয়ে আসে। উপস্থিত হয় সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। নিজেকে শক্ত প্রমাণের আপ্রাণ চেষ্টায় থাকা শিক্ষার্থীটিরও একসময় নোনাজলে চোখ ভিজে যায়। ভিড়ের মাঝে হঠাৎ কারো হুহু করে কান্নার আওয়াজ ভেসে ওঠে। একে একে ১৩ ব্যাচের সবাই কান্নায় ভেঙে পড়েন। কান্নায় ভেঙে পড়েন জুনিয়র ব্যাচের শিক্ষার্থীরাও।
চলার পথে চারটি বছরের সাথী ছিল যাঁরা, আর কি কখনও একসাথে পাশে দাঁড়াবেন তাঁরা? কেউ জানেন না উত্তর। বুকভর্তি শূন্যতা নিয়েই ক্ষান্ত থাকেন সবাই।
নোবিপ্রবির শিক্ষা বিভাগের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী মুসরাত জাহান মারিয়া বলেন, ‘সবসময় নোবিপ্রবির র্যাগ ডের গল্প শুনে এসেছি। এবার প্রত্যক্ষভাবে উপভোগ করলাম। যতটা আশা করেছিলাম তার চাইতে অনেক বেশি মজা করেছি ব্যাচমেট আর সিনিয়রদের সাথে।’
আয়োজক ব্যাচের তথা শিক্ষা বিভাগের ১৪ ব্যাচের শিক্ষার্থী তাসনিম অরিন বলেন, ‘ডিপার্টমেন্ট এর জন্য প্রথম ব্যাচের জন্য বিদায়ের আয়োজন করতে পারা ১৪ ব্যাচের জন্য সৌভাগ্য।আমাদের চেষ্টা ছিল দিনটি যাতে সবার কাছে আজীবন স্মরণীয় হয়ে থাকে। ভাইয়া- আপুদের জন্য অনেক শুভকামনা রইলো।’
১৫ তম ব্যাচের শিক্ষার্থী মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘আনন্দ, কান্না দুই অনুভূতির মিশ্রণে একটি দিন কাটালাম। ভাইয়া আপুদের ভালো কিছু দেয়ার সকলের চেষ্টাই অনুষ্ঠানটিকে অসাধারণ করে তুলেছে। সবসময় ভালো থাকবেন আপনারা।’
যাদের জন্য এই আয়োজন সেই ১৩ তম ব্যাচের শিক্ষার্থী মাকসুদা মীম বলেন, ‘২০১৮ এর জানুয়ারির তিন তারিখ থেকে এক সাথে আমরা। হাজারো স্মৃতি আছে জড়িয়ে আছে। এক সাথে পরিক্ষা দেয়া, চড়ুইভাতি, বাংলাবাজারের পেয়াজু কিংবা সেলিম টং এর চা, রাজনৈতিক আলোচনা কিংবা ছোট ছোট বিষয়ের খুনসুটি। এগুলা ভুলবার নয়। বিদায় অবশ্যই পীড়া দেয়, তবে গত দুই দিন সবার সাথে এতো আনন্দ করেছি যে বিদায় বলে মনেই হচ্ছিল না। শিক্ষা বিভাগের দ্বিতীয় ব্যাচকে ভালবাসা ছাড়া কিছুই দেয়ার নেই এতো সুন্দর আয়োজন করার জন্য। ‘
ফেয়ারওয়েল অনুষ্ঠানের সভাপতি ও নোবিপ্রবির শিক্ষা বিভাগের চেয়ারম্যান ড. বিপ্লব মল্লিক বলেন, ‘তোমরা যারা এই ক্যাম্পাস থেকে বের হচ্ছো, “শিক্ষা বিষয়ক গবেষণাতে তোমরা আরও বেশি অবদান রাখার চেষ্টা করবে। তোমাদের হাত ধরেই সূচিত হবে অনন্য এক বাংলাদেশ। তোমাদের সবার মঙ্গল কামনা করি।’
Leave a Reply