ক্যাম্পাসে যাওয়া-আসার এই যানবাহন নিয়ে আবেগ, রোমাঞ্চ শুধু নোয়াখালী নয়, এর বাইরের জেলা বা শহরগুলোয়ও আছে। একেকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের লাল, নীল, আকাশি, ধূসর কিংবা সবুজরঙা বাসগুলো অনেক শিক্ষার্থীর স্বপ্ন ফেরি করে বেড়ায়। যাঁরা এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়েন, তাঁদের অনেকের একটা বড় সময় কাটে এই বাসে বসে। তাই বাসযাত্রার সঙ্গে জড়িয়ে থাকে বহু স্মৃতি। ওই বাসের কোনো যাত্রীর সঙ্গে কথা বলে দেখুন, তাঁর ঝোলায় গল্পের শেষ নেই।
নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী মাহমুদা বিথী বলছিলেন নীল-সাদারঙা বাসগুলো তাঁকে কীভাবে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হতে অনুপ্রেরণা জোগাল। ‘আমার স্কুল লাইফ থেকেই খুব ইচ্ছা ছিল নোবিপ্রবি তে পড়ার। যেহেতু বাসা নোয়াখালিতেই ছিলো তাই যখন নীল সাদা বাস গুলো দেখতাম মনে হতো আমিও এই ভাবে ভাইয়া আপু দের মতো ক্যাম্পাসে যাবো। তাই স্কুল -কলেজ দুটোতেই টার্গেট ছিল কীভাবে নোবিপ্রবি তে চান্স পাওয়া যায়। আর প্রত্যেক বার নোবিপ্রবির নীল সাদা বাস দেখলেই নিজের মধ্যে একটি তীব্র ইচ্ছা এবং অসম্ভব স্পৃহা আসতো যেভাবেই হোক পরিশ্রম দ্বারা আমাকে বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পেতেই হবে। যখন স্কুলে যেতাম দেখতাম ভাইয়া আপুরা রাস্তার ধারে বাসের জন্য অপেক্ষা করছেন। বাসগুলোর দিকে তাকিয়ে শুধু প্রার্থনা করতাম, শিক্ষার্থীর পরিচয়ে এই বাসে চড়ার সৌভাগ্য যেন আমার হয়। সেই স্বপ্ন সত্যি হয়েছে।সৃষ্টিকর্তার ইচ্ছায় আমি এখন এই ক্যাম্পাসে অধ্যয়নরত।’
মাইজদী হাউজিং থেকে নিয়মিত ক্যাম্পাসের বাসে যাতায়াত করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০১৯-২০ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষা বিভাগের শিক্ষার্থী শামীমা খানম মিতু। তিনি মনে করেন, ক্যাম্পাসের বাসে যাতায়াত করাটা নারী শিক্ষার্থীদের জন্য একটু বেশি সুবিধাজনক। বললেন, ‘নিজের ক্যাম্পাসের বাসে যাতায়াত করলে একটা আলাদা গর্ব যেমন কাজ করে, তেমনি একজন নারী হিসেবে এই বাসে আমি অনেক বেশি নিরাপদ বোধ করি। সে জন্য কখনো কখনো একটু বেশি অপেক্ষা করতে হলে, কিংবা শিডিউল এদিক-ওদিক হয়ে গেলেও ক্যাম্পাসের বাসেই যাতায়াত করতে চেষ্টা করি।’
ক্যাম্পাসের বাসগুলোর প্রতি শিক্ষার্থীদের ভালোবাসা টের পাওয়া যায় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর পরিবহন চত্বরে গেলেও। বাসের সামনে দাঁড়িয়ে দল বেঁধে ছবি তোলার চিত্র দেখা যায় নিয়মিত। বিশেষত, প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীদের জন্য তো এটি রীতিমতো ‘অবশ্যকর্তব্য’। প্রেজেন্টেশনের দিনও ফরমাল ড্রেস আপে সবাইকে দেখা যায় বাসের সাথে ছবি তুলতে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের কল্যাণে নিজেদের এই আনন্দ সবার সঙ্গে ভাগ করে নেন শিক্ষার্থীরা।
আবাসিক শিক্ষার্থীদের সাথে ক্যাম্পাস জীবনের যোগসূত্র তৈরির প্রথম মাধ্যম যেমন বিশ্ববিদ্যালয়ের হল, তেমনি অনাবাসিক শিক্ষার্থীদের সাথে ক্যাম্পাসের প্রথম ভালোবাসা হয়ে থাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের লাল ও নীল- সাদা বাসগুলো।
বাসের নামগুলোও চমকপ্রদ। যেমন- রজনীগন্ধা, হাসনাহেনা, টিউলিপ, সূর্যমুখী, শাপলা, ডালিয়া, মালতী ইত্যাদি। যাত্রীরা প্রায় সমবয়সী হওয়ায় বাসের জন্য অপেক্ষার সময়টি যেমন আড্ডায় মুখর হয়, তেমনিভাবে কখনো কখনো চলন্ত বাসেই জমে ওঠে গানের আসর।
ক্যাম্পাসের বাসে দল বেঁধে যাতায়াত করতে করতে শিক্ষার্থীদের মধ্যে একটি আলাদা বন্ধনও তৈরি হয়েছে বলে মনে করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসরাত জাহান নামের এক শিক্ষার্থী। তিনি বলেন, ‘ক্যাম্পাসের বাসে নিয়মিত যাতায়াত করলে বাসকেন্দ্রিক একটা কমিউনিটি গড়ে ওঠে। অন্যান্য বিভাগের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে একটা সখ্য তৈরি হয়। আমরা যাঁরা অনাবাসিক শিক্ষার্থী, তাঁদের জন্য এটি একটি বড় সুযোগ। দেখা যায়, দুজন দুই বিভাগের শিক্ষার্থী, অথচ বাসযাত্রার সুবাদেই তাঁরা হয়ে ওঠেন কাছের বন্ধু। এই বন্ধুত্ব ও বন্ধনই তো বিশ্ববিদ্যালয়জীবনের সবচেয়ে বড় সম্পদ।’
দিনশেষে এই নীল- সাদা বাসগুলো হয়তো বলে ওঠে, ‘আমি আড়ম্বরপূর্ণ কিছু নই, আমার এসি নেই, নেই ভালো আসনও, সবার জন্য নির্ধারিত জায়গাও নেই, অনেক সময় হয়তো দাঁড়িয়ে কিংবা ঝুলে যেতে হয়। তারপরও অনেকে স্বপ্ন বুনতে থাকে আমার কোলে বসে, আমার প্রতি তোমাদের যে দরদ তা অনুভব করি ক্যাম্পাসের বন্ধ দিনগুলোতে।’
প্রেরকঃ আব্দুল্লাহ আল মাহবুব শাফি,
শিক্ষার্থী, নোবিপ্রবি।
Leave a Reply