এক ব্যক্তি, সে ভালো স্বভাবের, বড় উন্নত চরিত্রের, ভালো মানুষ; কিন্তু তার ঘরবাড়ি, অফিস আদালত, বসার জায়গা, অন্যের কাছে জাহির করার মত কোন অবস্থানই সুন্দর নয়। সে মনস্থ করলো যে, এরকম আর চলবে না; আমার সবকিছুই সুন্দর হওয়া চাই। আমার বাড়ি সুন্দর হওয়া প্রয়োজন, অফিস আদালত সুন্দর হওয়া প্রয়োজন। সহজ পথে এতদিন পর্যন্ত আমি চলেছি, আমি সম্পদ অর্জন করতে পারিনি, সম্মান অর্জন করতে পারিনি। এতদিন আত্মীয়-স্বজনের সাথে সম্পর্ক রেখেছি, সহপাঠীদের সাথে, সহকর্মীদের সাথে, সহযোগীদের সাথে ভালো সম্পর্ক রেখেছি,
বিভিন্নভাবে তাদের পিছনে খরচ করেছি , এতে আমার কাছে সম্পদ জমেনি আর আমার আনুষঙ্গিক কোনো কিছুই সুন্দর হয়নি। এখন আমি ঠিক করেছি, আমার আনুষঙ্গিক সবকিছুই সুন্দর বানাব। ধরুন আমার বাড়ি সুন্দর বানাতে গেলে আমার জমির প্রয়োজন, সম্পদের প্রয়োজন। অতএব এখন থেকে আর দান-খয়রাত করব না; সহপাঠীর, সহযোগী, সহকর্মী, আত্মীয়-স্বজনের সাথে সম্পর্কও রাখবো না। আমার কাছে যদি কেউ আসে, তো তার পিছনে অর্থ এবং সময় কোনটাই আর ব্যয় করব না; সততাও রক্ষা করব না। কারণ, সৎ পথে কোন কিছুই উপার্জন করা যায় না। মিথ্যা বলতে হবে, জুলুম করতে হবে, অন্যায় করতে হবে।
সুতরাং যেহেতু সে তার মনোরঞ্জনের আনুষঙ্গিক সবকিছুই সুন্দর করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সুতরাং সে দান-খয়রাত , অন্যের পিছনে যা ব্যয় করত, তা ছাড়লো; দানশীলতা ছেড়ে সে কৃপণ হলো। সহকর্মীদের সাথে সর্ম্পকও ছেদ করলো। সবার কাছে সে প্রিয় ছিল, এখন সবার কাছে সে অপ্রিয় হলো। সৎ ছিল, এখন অসৎ পথে যা পাওয়ার না, তাই পাওয়া আরম্ভ করে অসৎ হয়ে গেল। পূর্বে নৈতিকভাবে , আইন অনুযায়ী সবকিছু করতো কিন্তু এখন আর নৈতিকভাবে তার সবকিছু চলে না, অনৈতিকভাবে প্রমোশন, আপগ্রেডেশন ইত্যাদি আনুষঙ্গিক যা যা প্রয়োজন তা মহাশক্তিধর চেয়ারের অধিকারী কারো কাছ থেকে যা কিছু দিয়েই হোক না কেন! আইনকে উপেক্ষা করে, নির্বাহী আদেশই হোক না কেন! তা তাকে নিতেই হবে। আর ধীরে ধীরে কয়েক বছর পরে সে ঠিকই বিরাট ক্ষমতার অধিকারী হয়ে গেল। বিরাট জি হুজুর জি হুজুর বাহিনী বানিয়ে ফেললো। তার পছন্দনীয় আলিশান ঐ মহলে সে এখন বসবাস করে। এখন তার সেই ‘আমার’ , যেভাবে সে চেয়েছিল, বড় সুন্দর হয়েছে; কিন্তু তার সেই ‘আমার’টা বানাতে গিয়ে নিজের অজান্তেই তার ‘আমি’টা একেবারে কুৎসিৎ হয়ে গিয়েছে। এক সময় সে সবার সাথে ভালো কথা বলতো, ভালোভাবে বলতো, বিনয়ের সাথে চলতো, দানশীল ছিল, এখন সে কৃপণ হয়ে গেল। এক সময় সে সৎ ছিল, এখন সে অসৎ হয়ে গিয়েছে। এক সময় সে পরোপকারী ছিল , এখন সে জালিম হয়েছে। অর্থাৎ, এখন তার ‘আমি’র বিনিময়ে ‘আমার’ সুন্দর করেছে।
অপরদিকে অন্য এক ব্যক্তি, তার নিকট সুন্দর একটি বসার জায়গা ছিলনা, অফিসিয়াল ডেকোরেশন ছিলনা , ভালো ডিগ্রি এই ধরুন পিএইচডি, পোস্টডক,পোস্ট গ্র্যাজুয়েশন ইত্যাদি ইত্যাদি, প্রশাসনিক ক্ষমতা, সুন্দর বাড়ি ছিলনা, সম্পদ ছিলনা, জমিজমা ছিলনা, আরো অনেককিছুই ছিলনা; কিন্তু সে দানশীল ছিল , উদার ছিল বিনয়ী ছিল , সহপাঠী সহকারি,সহকর্মীদের সাথে ভালো আচরণ করে ,আত্মীয়-স্বজনের সাথে সর্ম্পক করেছে, প্রকৃতপক্ষে যার যা প্রাপ্য অধিকার পাওয়ার কথা তাদের প্রতি সে দৃষ্টি দিচ্ছে। একটা পর্যায়ে গিয়ে সিদ্ধান্ত নিল যে, এভাবেই আমাকে এখন চলতে হবে।
কেননা আমি সৃষ্টিকর্তার সামনে এমনভাবে হাজির হতে চাই, মহান সৃষ্টিকর্তা যেন আমাকে দেখে সন্তুষ্ট হন। তাঁর নজরে আমি যেন সুন্দর হই। সুতরাং এমন একটি প্রতিজ্ঞাবদ্ধ কার্যক্রম আরম্ভ করলো যে, আমি সুন্দর হবো, সৃষ্টিকর্তা যেন আমাকে পছন্দ করেন। তো এখন সে তার অসৎ আচরণ ছেড়ে দিয়ে, নিজেকে বিনয়ের ভেতর সীমিত করলো। ফলে স্বাভাবিকভাবেই তার সম্মান সাময়িকভাবে সমাজের কাছে অনেক কমে গেল। কারণ, অসৎভাবে অপার্জিত সম্মান তো এখন আর নেই। অন্যের যে সমস্ত অধিকার, যা সে জুলুম করে নিয়েছিলো, সেগুলো সে খোঁজ করে করে তার পাওনাদারকে ফেরত দিয়ে দিলো। যার কাছে মাফ চাওয়ার ছিল, মাফ চাইলো, পাওনাগুলো আদায় করলো। সবার সাথে দেখা করল, দেখলো তার একজন কলিগ , একজন সহকর্মী, বড় অভাবের মধ্যে আছে। তার কাছে গেল তার অভাবকে বোঝার চেষ্টা করল এবং তা দূর করার জন্য যা যা করা প্রয়োজন সবকিছুই সে করল। এখানে ‘অভাব’ বলতে প্রাপ্য, নৈকিক ও আইনগতভাবে সে যাপাবে, কিন্তু তাকে তা দেওয়া হয়নি সেটাকেই বোঝানো হয়েছে। সে এখন সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে সবার প্রাপ্য, যা কিছু ছিল সব আদায় করার পর যেটুকু তার কাছে রয়েছে, সেটুকুও সবার কল্যাণে দান করলো। প্রতিবেশীদের মধ্যে লক্ষ্য করলো, অনেক অভাবী আছে। সুতরাং সে নিজে যা খায়, প্রতিবেশীদেরকেও সেগুলো খাওয়ায়। দেখা গেলো, তার ‘আমার’ বলতে আর কিছুই এখন আর বাকি নেই। এক সময় যার বড় বাড়ি ছিল, এখন সে ছোট ঝুপড়িতে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছে। দামী দামী জামাকাপড় পড়তো, এখন সে একেবারে সস্তা আর সাদাসিদে জীবন অতিবাহিত করছে। তো তার ‘আমার’ বলতে যা ছিল, সব হারিয়ে ফেলেছে; কিন্তু তার ‘আমি’টা হয়ে গিয়েছে বড় সুন্দর। এখন আর কেউ তার বাড়ির দিকে তাকিয়ে বলে না যে, তার বাড়িটি বড় সুন্দর। অথচ এক সময় তার বড় সুন্দর বাড়ি ছিল। পথিক তার বাড়ির দিকে তাকিয়ে বলত, মাশাআল্লাহ, এ বাড়িটি তো অনেক সুন্দর! কিন্তু এখন তার বাড়ি আর সুন্দর না; কিন্তু গোটা প্রতিষ্ঠান অথবা অঞ্চলের লোকেরা তাকেই বেশি ভালোবাসে আর বলে যে, এই ব্যক্তিটি বড় সুন্দর। আগে ছিল তার বাড়ি সুন্দর, এখন তার বাড়ি আর সুন্দর নয় বরং সে নিজে সুন্দর। উল্লেখ যে বিশেষ বিশেষ জায়গায় ‘বাড়ি’ শব্দটিকে রূপক অর্থে ব্যবহার করা হয়েছে। এখানে ‘বাড়ি’ শব্দটি বিভিন্ন কিছু হইতে পারে এই ধরুন পোস্ট, পজিশন ইত্যাদি ইত্যাদি।
এইতো আর কয়দিন বাদেই আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির নির্বাচন। আসুন সবাই মিলে ঐসব সুন্দর মানুষদেরকে কাজ করার সুযোগ করে দেই যারা ‘আমার’ সব ঠিক করার জন্য নয় বরং ‘আমি’টাকে সুন্দর বানাবে। আর যার ‘আমি’টা সুন্দর হয়ে যায় সে সকলের জন্যই সুন্দর কাজ করবে সেটাই প্রত্যাশা। প্রত্যাশা করছি আগামী নির্বাচনে যাদের ‘আমি’টা সুন্দর হবে তারাই যেন জয় যুক্ত হয়।
লেখক-
আবুল বাশার রিপন খালিফা সহযোগী অধ্যাপক ফার্মেসি বিভাগ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।
Leave a Reply