আজ বিশ্ব পরিবেশ দিবস। পৃথবী যখন একসাথে মহামারী করোনা ভাইরাস সংক্রমণের শিকার এবং বেশিরভাগ দেশগুলি লকডাউনের সাথে লড়াই করছে, পরিবেশ তখন কিছুটা উপকৃত হয়েছে বলে মনে করা হয়। লকডাউনে অনেক দেশের প্রকৃতি তার স্থানগুলি পুনরুদ্ধার করতে ব্যস্ত ছিল। বিশ্বের পরিবেশও ছিল অনেকটা দূষণমুক্ত।
পরিবেশ এখন মানুষের উদ্বিগ্ন ক্রিয়াকলাপের ক্রমাগত অভাবে শ্বাস-প্রশ্বাস নিতে এবং নিজেকে একটু গুছিয়ে পরিষ্কার করে নিতে পারছে। অন্যান্য জিনিসের মতো পরিবেশেরও কিছুটা ডাউনটাইমের প্রয়োজন আছে, যার কিছুটা সময় পেয়েছে প্রকৃতি এই দীর্ঘ লকডাউনে।
প্রতি বছর ৫ই জুন পালন করা হয় এ দিবসটি। জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ২৭ তম অধিবেশনে বিশ্বের জনসাধারণকে পরিবেশ সম্পর্কে সচেতন করার উদ্দেশ্যে উক্ত অধিবেশনের অনুমোদনক্রমে ১৯৭৪ সাল থেকে দিবসটি প্রতিবছর সারাবিশ্বে পালিত হয়ে আসছে। প্রতিবছর বিশ্ব পরিবেশ দিবসে ভিন্ন ভিন্ন প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করে থাকে জাতিসংঘ। জাতিসংঘ পরিবেশ এ বছর বিশ্ব পরিবেশ দিবসের প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করেছে ‘Biodiversity’ বা ‘জীববৈচিত্র্য’ আর স্লোগান ‘Time for nature’ বা ‘প্রকৃতিকে বাঁচানোর এখনই সময়’। অর্থাৎ জীববৈচিত্র্য তথা প্রকৃতিকে বাঁচানোর সময় এখনই।
পৃথিবীতে বিরাজমান জীবগুলোর প্রাচুর্য এবং ভিন্নতাই হলো জীববৈচিত্র্য। আমেরিকান জীববিজ্ঞানী ই.এ.নরসে এবং তার সহযোগীদের মতে “জৈববৈচিত্ৰ্য হল জল, স্থল সকল জায়গায় সকল পরিবেশে থাকা সকল ধরনের জীব এবং উদ্ভিদের বিচিত্ৰতা।” পৃথিবীতে এখন পর্যন্ত প্রায় ১৩ লাখ প্রানী প্রজাতি এবং ৪ লাখ উদ্ভিদ প্রজাতির বর্ণনা পাওয়া যায়। মানুষ পরিবেশের একটা অংশমাত্র তাই পরিবেশ রক্ষায় এবং মানুষকে টিকে থাকতে হলে বাস্তুতন্ত্রের অন্যান্য জীব তথা জীববৈচিত্র্যের সাহায্য প্রয়োজন। আমাদের পৃথিবী থেকে বর্তমানে ১ মিলিয়ন উদ্ভিদ এবং প্রাণীজ প্রজাতি বিলুপ্তির পথে, এই ইস্যুতে মনোযোগ দেওয়ার মতো গুরুত্বপূর্ণ সময় আগে কখনো হয়নি।
জাতিসংঘের পরিবেশগত কর্মসূচির (ইউএনইপি) মতে: “বাস্তুসংস্থান পুনরুদ্ধারের বিষয়ে জাতিসংঘের দশক (২০২১-২০৩০) হ্রাস ও ধ্বংসপ্রাপ্ত বাস্তুতন্ত্রের পুনঃস্থাপনের ব্যয় বহুল পরিমাণে বৃদ্ধি করার উদ্দেশ্যে জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ ও পুনরুদ্ধারের প্রতি জাতীয় প্রতিশ্রুতি দেওয়ার জন্য ২০২০ এক গুরুত্বপূর্ণ বছর।”
সারা বিশ্ব বিগত চারমাস প্রায় লকডাউনে কোভিড-১৯ এর কারণে। এসময় স্থলে বায়ুদূষণের পরিমাণ কমেছে, দূষণ কমেছে সমুদ্রে, জীববৈচিত্র্য সমৃদ্ধ পর্যাটন অঞ্চলও স্বস্তিতে রয়েছে। লকডাউনে দেশের কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে দেখা মিলেছে ডলফিন, সমুদ্র পাড়ে দেখা গেছে হরিণের দৌড়, বালিতে জন্মছে সারি সারি ছোট উদ্ভিদ। সেন্ট মার্টিন দ্বীপে বেশি পরিমাণ ডিম পাড়ছে সামুদ্রিক কচ্ছপ। সবাই যেন ফিরে পেয়েছে তাদের আদি আবাসস্থল।
বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ভিন্ন ধরনের জীববৈচিত্র্য পরিলক্ষিত হয়। তার মধ্যে রয়েছে সুন্দরবন, পাহাড়ি অঞ্চল, হাওর, শালবন ও সমুদ্র অঞ্চল। দেশের সুন্দরবন এক বিশাল জীববৈচিত্র্যের আধার। প্রায় ১০,০০০ বর্গকিলোমিটার আয়তনের পৃথিবীর বৃহত্তম নিরবিচ্ছিন্ন ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবন। বাংলাদেশের অংশে এর আয়তন প্রায় ৬,০১৭ বর্গকিলোমিটার বা ৬০ শতাংশ, বাকি ৪০ শতাংশ ভারতের বন। জীববৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ বিধায় ১৯৯২ সালে সুন্দরবন ৫৬০তম রামসার সাইট হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে। ইউনেস্কো ১৯৯৭ সালে সুন্দরবনের ১,৩৯,৭০০ হেক্টর বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য এলাকাকে ৭৯৮তম বিশ্ব ঐতিহ্য হিসেবে ঘোষণা করে।
১৯০৩ সালে মি. প্রেইন সুন্দরবনের গাছপালার উপর লিখিত তাঁর গ্রন্থে ৩৩৪টি উদ্ভিদ প্রজাতি লিপিবদ্ধ করেছেন। ১৬৫ প্রজাতির শৈবাল ও ১৩ প্রজাতির অর্কিড, ৫০টি প্রকৃত ম্যানগ্রোভ উদ্ভিদ প্রজাতির মধ্যে সুন্দরবনে আছে ৩৫টি প্রজাতি। সুন্দরবন নানা ধরনের প্রাণীবৈচিত্র্যে অনন্য, যার প্রকৃষ্ট উদাহরণ রয়েল বেঙ্গল টাইগার, যার সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ আবাসস্থল সুন্দরবন, এটি বনের প্রাকৃতিক সিকিউরিটি গার্ড হিসেবেও কাজ করে থাকে। বন বিভাগের তথ্যমতে ২০০৪ সালে শাবকসহ বাঘের সংখ্যা ছিল ৪৪০টি। ১১ বছরে বাঘের সংখ্যা কমে ২০১৫ সালে বাংলাদেশ অংশে বাঘের সংখ্যা দাড়ায় ১০৬টি। ২০১৯ সালে সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা আবার কিছুটা বেড়ে দাড়ায় ১১৪টি। বর্তমানে এর সংখ্যা আরো ৫০টি বৃদ্ধি পেয়েছে বলে ধারণা বন বিভাগের। চোরা শিকারি আর কিছু অসাধু ব্যবসায়ী ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ বাঘের আবাসস্থল ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। সেই সঙ্গে হরিণ শিকারের কারণে খাদ্য সংকটে বাঘের সংখ্যা বাড়ছে না।
সুন্দরবনে প্রায় ২৮৯ প্রজাতির স্থলজ প্রাণী বাস করে। ৪২ প্রজাতির স্তন্যপায়ী, ৩৫ প্রজাতির সরীসৃপ, ৮ প্রজাতির উভচর এবং বিভিন্ন প্রজাতির মাছসহ ২১৯ প্রজাতির জলজ প্রাণী। অমেরুদন্ডী প্রাণীর মধ্যে কতিপয় মোলাস্কা এবং ক্রাসটেসিয়ান গুরুত্বপূর্ণ প্রজাতি রয়েছে যা বনের জীববৈচিত্র্যের প্রকারের প্রজাতিগত ও বংশগতীয় বৈচিত্র্যের এক অনন্য নিদর্শন। প্রায় ৫০ প্রজাতির পাখি পরিযায়ী এবং সুন্দরবনের কীটপতঙ্গের, অনুজীব, পরজীবীর বৈচিত্র্য এখানকার বাস্তুতান্ত্রিক বৈচিত্র্যতাকে সমৃদ্ধ করেছে।
গবেষণা মতে সুন্দরবনের প্রানীবৈচিত্র্যের মধ্যে ২ প্রজাতির উভচর, ১৪ প্রজাতির সরীসৃপ, ২৫ প্রজাতির পাখি এবং ৫ প্রজাতির স্তনপায়ী বর্তমানে হুমকির মুখে।
সুন্দরবন শুধুমাত্র জীববৈচিত্র্যের জন্যই সংরক্ষণ করা জরুরী নয় বরং প্রতিকূল পরিবেশে এটি দেশের দক্ষিণাঞ্চল তথা পুরো দেশের জন্য চীনের মহাপ্রাচীরের মতো প্রতিনিয়ত ঘূর্ণিঝড়ের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের সাথে লড়ে যাচ্ছে। যার ফলে দেশে ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ অনেকাংশে কম হয়।
দেশে সম্প্রতি সুপার সাইক্লোন আম্পানের তাণ্ডবের গতি অনেক কমে যায় সুন্দরবনের জন্য, এটি না থাকলে হয়তো দেশের দক্ষিণাঞ্চলে ব্যাপক প্রাণহানিসহ ওই অঞ্চলের পুরোটা লোনাপানিতে তলিয়ে যেতে পারতো। সুন্দরবন ঢাল হিসেবে রক্ষা করছে এটিই প্রথমবার না। এর পূর্বেও সিডর, আইলা, ফণী বা বুলবুলের মতো অসংখ্য ঘূর্ণিঝড়কে সুন্দরবন থামিয়ে দিয়েছে তার বৃক্ষরাজি দিয়ে।জীববৈচিত্র্য, প্রকৃতি থেকে হারিয়ে যাওয়াটা এখন একটি বৈশ্বিক সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। এটি আর নির্দিষ্ট কোনো দেশের ভৌগোলিক সীমার মধ্যে আবদ্ধ থাকছে না, পুরো পৃথিবী জুড়েই এ সমস্যা প্রকট আকার ধারণ করছে। প্রকৃতি, পরিবেশ ও জলবায়ুর সাথে জীববৈচিত্র্যের রয়েছে নিবিড় সম্পর্ক।
বিশ্বের জীববৈচিত্র্য, পরিবেশ ও বাস্তুসংস্থানের ওপর প্রকৃতিগতভাবে যে প্রভাব ফেলছে, তার ওপর আমাদের নিয়ন্ত্রণ নেই।জীববৈচিত্র্য তার নিজ গতিপথে চলে, সে নিজেই তার ক্ষতি পুষিয়ে নিতে পারে কিন্তু মানুষের কর্মকাণ্ড এতো বেশি প্রকৃতি বিধ্বংসী হয়েছে যার ফলে অধিক পরিমাণ প্রকৃতিতে কার্বনের মাত্রা অস্বাভাবিক বৃদ্ধি, ক্ষতিকর ভারী ধাতুর পরিমাণ বৃদ্ধি এবং নতুন নতুন ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়া, ছত্রাক, ভাইরাসের সৃষ্টি হচ্ছে। যা প্রকৃতি ও তার জীববৈচিত্র্য নির্মম ধ্বংসের ফলাফল। গতবছর ২০১৯ সালের আগস্টের দ্বিতীয় সপ্তাহে পৃথিবীর সর্ববৃহৎ রেইন ফরেস্ট আমাজন জ্বলছিল। যা নিয়ে পৃথিবীর অনেক প্রান্ত থেকে নিন্দার ঝড় উঠেছিল। পৃথিবীর ফুসফুস খ্যাত আমাজনে ৩০ লাখ প্রজাতির গাছপালা রয়েছে। যা পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে থাকা অক্সিজেনের ২০ শতাংশ আমাজন সরবরাহ করে থাকে। গবেষকদের মতে, এখানকার বন্য প্রজাতিরা ২০০ কোটি মেট্রিক টন কার্বন-ডাই-অক্সাইড শোষণ করে থাকে।
বিশ্বে আজ করোনা ভাইরাসের মতো পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে পরিবেশের ক্ষতি ও বন্যপ্রাণীর অভয়ারণ্য ধ্বংসের ফলে তারা লোকালয়ে প্রবেশ করেছে। যা মানুষের বেচে থাকার জন্যও হুমকি হয়ে দাড়িয়েছে।
বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো আমাদের দেশেও পরিবেশের এমন ধ্বংসযজ্ঞ কর্মকাণ্ড বেড়েই চলেছে যেমন: নদী ভরাট, নদী দূষণ, অতিরিক্ত মাত্রায় পলিথিনের ব্যবহার, অবাধ বৃক্ষনিধন, বায়ুদূষণ, উপকারি প্রাণিকুল ধ্বংস, পাহাড় কাটা, বনায়ন ধ্বংস, ইট-ভাটার কালো ধোয়া, নিয়ম না মেনে নদীতে অতিরিক্ত মাত্রায় মাছ শিকার, কৃষি জমিতে নগরায়ন প্রধান।
সমুদ্র পৃষ্ঠ থেকে স্থলে উচ্চ তারতম্যের তাপমাত্রা পার্থক্যের কারণে সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড়ে উপকূল অঞ্চল বন্যায় প্লাবিত হওয়া এখন স্বাভাবিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে। বৃক্ষ নিধনের ফলে পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধিতে গ্রিনল্যান্ডেও অস্বাভাবিক মাত্রায় বরফ গলছে। প্রতিনিয়ত পৃথিবীর উচ্চ তাপমাত্রা নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে পরিবেশের উপর। অস্ট্রেলিয়া বনের গাছপালা গতবছর ২০১৯ এর শেষ থেকে এবছরের প্রথম দিক পর্যন্ত আগুনে পুড়ছিলো। সেখানে কমপক্ষে ৫০ লাখ পশু-পাখি হারিয়ে গিয়েছে। যা জীববৈচিত্র্যে কয়েক দশকেও পূরণ হওয়ার নয়। এভাবেই বিশ্বের অনেক দেশে জীববৈচিত্র্যের বিনাশ হয়ে চলেছ।
পরিবেশ বা বাস্তুতন্ত্রের স্থিতিশীলতা রক্ষার জন্য জীববৈচিত্র্যের প্রভাব রয়েছে। প্রকৃতিতে যেসকল জীব এক সময় অপ্রয়োজনীয় মনে বলে করা হতো, সময়ের বিবর্তনে দেখা গেছে তারা প্রকৃতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ। একসময় আমেরিকার চেসাপিক উপকূলে অসংখ্য ঝিনুক ছিল। সেগুলো মাত্র তিন দিনে গোটা এলাকার পানি পরিশুদ্ধ করতে পারতো কিন্তু এখন ৯৯ ভাগ ঝিনুক বিলুপ্তির ফলে অবশিষ্ট ঝিনুকেরা এক বছরেও সেই পানি আর পরিশুদ্ধ করতে পারে না।
বিশ্বের পরিবেশেকে দূষণমুক্ত করার সাথে সাথে তার জীববৈচিত্র্যের অভয়ারণ্যকে রক্ষণাবেক্ষণ করা এখন সময়ের দাবি।
লেখা: রিফাত নূর রাব্বি, শিক্ষার্থী,
কৃষি বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।
Leave a Reply