করোনা- মহামারী নাকি মহাপাপ?
২০১৯ সালের ডিসেম্বর মাসে চীনের উহানে করোনা রোগের উৎপত্তি ঘটে!!কিভাবে হয়েছে এবং কিভাবে পুরো বিশ্বে এটি ছড়িয়ে পরলো! করোনা হলে যেসকল লক্ষণ হয়, তাছাড়া শ্বাসকষ্ট হয় বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এগুলো আমাদের কোনো কিছুই অজানা নেই!
এ পর্যন্ত আক্রান্ত প্রায় ৩ কোটি এবং মৃত্যুবরন করেছেন প্রায় ১০ লক্ষ।।অর্থাৎ লক্ষ লক্ষ মানুষ দুনিয়া ছেড়ে চলে যাচ্ছেন!!এগুলো কিছুই না জানার বাহিরে নয়!প্রতিনিয়ত টিভি নিউজ, অনলাইনসহ বিভিন্ন মাধ্যমে আমাদের কাছে নিউজ পৌছে যাচ্ছে!!
এতো কিছু ছাড়াও করোনা একটি “ছোঁয়াচে রোগ” এটা কোনো মতেই অস্বীকার করতে পারিনা আমরা!! যার ফলে আমরা একজন অন্যজনের থেকে প্রটেকশন নিয়ে চলছি।কারন নিজের সুস্থতাটাও জরুরী।।
কিন্তু!!
কিন্তু এতো কিছুর মাঝেও আমাদের আশেপাশে যারা আক্রান্ত হচ্ছে তাদের প্রতি আমাদের কঠোর মানসিকতা হওয়া কি উচিৎ? মোটেও নয়!
কারন?
কারন আক্রান্তের বেশিরভাগ মানুষ আবার সুস্থ হয়ে আমাদের মাঝে ফিরে আসছেন ধীরে ধীরে। কিন্তু এই সুস্থতা কখন সম্ভব?যখন আমাদের মানবিকতার সৃষ্টি হবে!!
“একজন মানুষের সুস্থতা যেমন নির্ভর করে তার শারীরিক অবস্থার ওপর,তেমনি নির্ভর করে মানসিক অবস্থার ওপর!একজন ব্যক্তি মানসিক ভাবে সুস্থ থাকলেই শারীরিক ভাবে সুস্থ হয়ে উঠতে তার সময় লাগে না!”
তবে?
তবে কি আমরা আক্রান্ত মানুষ গুলোকে মানসিক ভাবে সুস্থ রাখতে পারছি??
না,মোটেই না!!
বরং মাঝে মাঝে গুজব ছড়িয়ে সুস্থ মানুষকে মিথ্যা অপবাদ দিয়ে বসছি।জ্বর কাশি হলেই কি করোনা? তাহলে তো লক্ষণ ব্যতীত করোনায় কেউ দুনিয়া ছাড়তো না।এটা ভুল ধারনা,ঋতুপরিবর্তনেও অনেক সময় জ্বর কাশি হচ্ছে!!তবে আমরা গুজব ছড়িয়ে কি মজাটা পাচ্ছি?বরং সুস্থ মানুষগুলোকেও মানসিক ভাবে ভীত করে তুলছি।।
আমাদের জীবনের সবচেয়ে কাছের মানুষ পরিবার ও প্রতিবেশী,এই পরিবারই আমাদের জীবনের সবচেয়ে ভালো বন্ধু,
মাসখানেক আগের কথা,এক শিশুর আক্রান্তের ফলে শিশুর বাবামা শিশুকে নিয়ে দৌড়াদৌড়ি করলো, এক হাসপাতাল থেকে অন্য হাসপাতাল, তবুও শিশুটিকে বাঁচাতে পেরেছিলো না!একটি new born baby জন্মের ১৯ দিনের মাথায় মারা যায়,বাচ্চার মাকে হাসপাতাল এ ঢুকতে দেওয়া হয় না,সে বাহিরেই অপেক্ষা করে চলেন,শিশুটিও নির্মম দুনিয়ায় থাকতে পারে নি!এক শিশু করোনায় আক্রান্ত, বাবা মেয়ে ছাড়া থাকতে না পেরে পলেথিনে বাচ্চাকে রেখে তাকে আদর করেন!!একজন মানুষ তার স্ত্রীর আক্রান্ত হওয়ার পর তাকে মোটেও একা পরতে দেন নি!এমন হাজার হাজার ঘটনা ঘটেছে ভালো মানুষগুলোর।।
তবে আবার সেই পরিবার ও প্রতিবেশী যখন হয়ে ওঠে শত্রু তখনই ঘটে অমানবিক আচরন!!
নজরুল ইসলাম (৫৫), বাড়ি দাউদকান্দি উপজেলার সুন্দলপুর ইউনিয়নের মুদাফর্দি গ্রাম,একজন গার্মেন্টস কর্মী! করোনাভাইরাসের লক্ষণ ও উপসর্গ নিয়ে বাড়ি ফেরায় ঘরে ঢুকতে দেননি তার স্ত্রী-সন্তানরা। বাধ্য হয়ে আশ্রয় নেন বোনের বাড়িতে। গত ৬ মে সেখানেই তার মৃত্যু হয়।(চ্যানেল আই অনলাইন নিউজ)
দিনাজপুরের ঘোড়াঘাট উপজেলার শিক্ষক উম্মে হানি। শরীরে করোনা উপসর্গ দেখা দিলে নমুনা সংগ্রহে আসেন চিকিৎসকরা। এরপরই শুরু হয় সামাজিক হেনস্তা। প্রতিবেশীরা তাকে কটুক্তি করে ফেসবুকে দেন পোস্ট, অনেকে আবার আসেন ফেসবুক লাইভেও।
অমানবিক এমন ঘটনা আছে কুমিল্লাতেও। গত ১৮ এপ্রিল লক্ষ্মীপুর থেকে পালিয়ে কুমিল্লায় যেতে বাধ্য হন জুতার কারখানার শ্রমিক কার্তিক দাস। করোনায় আক্রান্ত হলে বন্ধ করে দেয়া হয় তার খাবার, এমনকি হুমকি দেয়া হয় পুড়িয়ে মারার।(চ্যানেল ২৪)
কয়েক দিন ধরে শ্বাসকষ্টে ভুগছিলেন ৫৫ বছর বয়সী মনিরা বেগম। রাজধানীর মিরপুর এলাকার একটি বস্তিতে ছেলের সঙ্গে থাকতেন তিনি। করোনার উপসর্গ থাকায় আক্রান্ত সন্দেহে হওয়াই নিজের ছেলেই তাকে ৬ জুন ২০২০,শনিবার দুপুরে ফেলে যান ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সামনে।(প্রথম আলো)
করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার উপসর্গ থাকায় বেড়া উপজেলার যমুনা নদীর দুর্গম চরে মানসিক ভারসাম্যহীন এক বৃদ্ধকে (৭০) ফেলে রাখার ঘটনাও ঘটেছে।
৭ সেপ্টেম্বর, ২০২০ শনিবার রাতে এমনই অমানবিক ঘটনার সাক্ষী হয়েছে ভারতের তেলঙ্গানা রাজ্যের ভেলেরু মণ্ডলের পিচারা গ্রাম। ৮২ বছরের ওই বৃদ্ধার নাম লাচ্চাম্মা। তাঁর চার ছেলে ও এক মেয়ে রয়েছে।করোনায় আক্রান্ত ৮২ বছরের বৃদ্ধা মাকে মাঠে ফেলে দিয়ে যাওয়ার ঘটনা বোধ হয় সব সীমা ছাড়িয়েছে। লাঠি ছাড়া হাঁটতে পারেন না বৃদ্ধা। সম্প্রতি তাঁর কোভিড রিপোর্ট পজিটিভ এসেছে। তার পরই ছেলেরা তাঁকে বাড়ি থেকে বের করে ফেলে দিয়ে এসেছেন চাষের জমিতে।(কালের কণ্ঠ)
২৫ জুন, ২০২০,মিশরে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত এক নারীকে পাঁচ তলা থেকে ফেলে দিয়েছে তার স্বামী। এ ঘটনায় ওই স্বামীকে গ্রেপ্তার করা কারাগারে পাঠিয়েছিলেন পুলিশ। বৃহস্পতিবার মধ্যপ্রাচ্যের সংবাদমাধ্যম আরব নিউজের এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়েছে।স্বামী পুলিশকে বলেন, ‘আমি করোনায় আক্রান্ত হওয়ার ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। আমার স্ত্রী তিনবার নমুনা পরীক্ষা করায়। কিন্তু তিনবারই তার ফল পজিটিভ আসে। পরে আমি তাকে বাসা থেকে চলে যেতে বলেছিলাম। কিন্তু সে রাজি হয়নি, তাই তাকে ফেলে দিয়েছি।’
উপরোক্ত ঘটনাগুলো গত ৬ মাসে ঘটে যাওয়া কিছু অমানবিক ঘটনা,যেখানে মা বাবা নিজের সন্তানের জন্য জীবন দিতে রাজি,সেখানে কিছু সন্তান মা বাবাকে ছেড়ে চলে যাচ্ছে বন জঙ্গল রাস্তা ঘাটে। এই অমনাবিক আচরনের শিকার হচ্ছেন করোনা নামক মহামারীতে আক্রান্ত মানুষ গুলো।তবে কি এটা মহামারী নাকি মহাপাপ!!মানুষের আচরনে মহামারী কি হয়ে উঠেছে মহাপাপ??
যেখানে উক্ত মরণব্যাধি ছোঁয়াচে রোগ মানুষকে করে তুলেছে অসহায়, অমানবিক আচরনের শিকার হচ্ছেন নিচের আপনজন হতেই,সেখানে ভালোমানুষ রূপের কিছু ডাক্তার,পুলিশ, সাংবাদিকসহ আরো সেচ্ছাসেবীরা আজও করে চলছেন এই অসহায় মানুষ গুলোর সাহায্য।।
রাস্তায় ফেলে দেওয়া মানুষ গুলোকে যেমন পুলিশ সেচ্ছাসেবী, সাংবাদিক গুলো তুলে এনে মেডিকেল এ ভর্তি করছেন,তেমনি আমাদের অসংখ্য ডাক্তার নার্স তাদেরই আপনজন হয়ে,চিকিৎসা সহ নিজের মত করে সুস্থ করে তোলার আপ্রাণ চেষ্টা করে চলছেন, এতে অবশ্য তারা এতে কখনো সফল আবার কখনো ব্যর্থ।
এতো কিছুর মাঝেও, বাংলাদেশের স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলেছে যে, করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়ার তিন ঘণ্টা পর ওই মৃতদেহে আর ভাইরাসটির কোন কার্যকারিতা থাকে না।এর পরেও ঢামেকে করোনায় আক্রান্ত মৃতদেহ রেখে স্বজনরা পালিয়ে গেছেন!তাছাড়াও করোনায় মৃতব্যক্তির জানাজা বা দাফন করতেও মানুষ ছিলো না!! বেশির ভাগ ক্ষেত্রে পুলিশ এবং সেচ্ছাসেবীর কিছু দল এই কাজ গুলো করেছেন।।
৬ জুলাই, ২০২০, রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতালে করোনায় মৃত যুবকের লাশ ফেলে পালিয়ে গেছেন স্বজনরা। আজাদ আলী (৩০) নামের ওই যুবক চিকিৎসাধীন অবস্থায় গত শনিবার দিবাগত রাত দেড়টার দিকে রামেক হাসপাতালের আইসিইউতে মারা যান। তিনি নওগাঁর পত্নীতলা উপজেলার জামগ্রাম এলাকার বাসিন্দা।এ ব্যাপারে হাসপাতালের উপ-পরিচালক ডা. সাইফুল ফেরদৌস বলেন, আমরা রোগীর স্বজনদের সাথে যোগাযোগ করলে তারা রোগী নেবেন না বলে জানিয়েছেন। এখন আমরা কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে লাশ দাফনের চেষ্টা করছি।(ডেইলি ইত্তেফাক)
২১সেপ্টেম্বর ২০২০,গত ১ আগষ্ট ঈদের দিন করোনাভাইরাসের উপসর্গ নিয়ে আশুলিয়ার জামগড়া এলাকা থেকে রিপন মিয়া (৩৫) নামের এক যুবককে আশুলিয়ার বাইশমাইল এলাকায় গণস্বাস্থ্য সমাজ ভিত্তিক মেডিক্যাল কলেজ এন্ড হাসপাতালে ভর্তি করেন তার স্ত্রী ও স্বজনরা।
পরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় সোমবার (৩ আগস্ট) দিবাগত রাতে ওই যুবক হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করলে তার লাশ রেখে স্ত্রী ও স্বজনরা পালিয়ে যায়।
করোনাভাইরাসে মৃত্যু হওয়া ওই যুবকের স্বজনদের না পেয়ে হাসপাতাল কতৃপক্ষ নিহত যুবককে স্বাস্থ্যবিধি মেনে বাইশমাইল এলাকায় একটি কবরস্থানে দাফন করার উদ্যোগ নিয়েছে। (বাংলাদেশ প্রতিদিন)
এছাড়াও প্রায় প্রতিদিনই ঘটে যাচ্ছে এমন অমানবিক কিছু ঘটনা, আর আমাদের কাছের বন্ধু হয়ে পাশে দাড়াচ্ছেন ডাক্তার, নার্স,পুলিশসহ কিছু সেচ্ছাসেবী!! তবে কি রক্তের সম্পর্কের চেয়েও বড় কিছু হলো মনুষ্যত্ব, এটাই কি সঠিক??
কথা হচ্ছে মানুষ কি ভয় পেয়ে এভাবে নিজেকে দূরে রেখেছেন?তবে ভাইরাল হওয়া কিছু জানাজা বা দাফন করানো ছবিতে জানাজা করা সেচ্ছাসেবীদের পেছনের মানুষ গুলো হা করে কি দেখছিলো?তবে কি করোনা-মহামারী না মহাপাপ? আমি জানি না,তবে জানাজাতে আসতে কি সমস্যা ছিলো জিজ্ঞেস করার খুব ইচ্ছা জেগেছিলো আমার ,তবে দুঃখিত জানা হয় নি!!
করোনা বিশ্বজুড়ে একটি বিশাল মহামারী আকারে ধারন করেছে,এতে অসংখ্য মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে, অনেক মানুষ না ফেরার দেশেও চলে যাচ্ছেন।
এই মানুষগুলোকে শারীরিক অসুস্থতার সাথে আমাদের থেকে মানসিক ভাবেও অসুস্থ হয়ে পরেছেন, আমাদের অমানবিক আচারনের কারনে! এসকল আচরনে দিন দিন পরিবেশটা গড়ে উঠছে মহামারী নয় যেন মহাপাপ হয়েছে। আক্রান্ত ব্যক্তি যেন পাপ করে ফেলেছেন।যেন মহামারী নয় মহাপাপ!!
ইসলামিক দৃষ্টিতে, মহামারী আল্লাহর গজব হলেও এতে আক্রান্ত মৃত ব্যক্তিকে পাপী-জাহান্নামি মনে করা যাবে না। রাসূল (সা.)-এর ভাষায় মহামারীতে মারা যাওয়া ব্যক্তিও শহীদ। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, আল্লাহর রাসূল (সা.) বলেছেন, পাঁচ প্রকার মৃত শহীদ: মহামারীতে মৃত, পেটের পীড়ায় মৃত, পানিতে ডুবে মৃত, ধ্বংসস্তুপে চাপা পড়ে মৃত এবং যে আল্লাহর পথে শহীদ হলো। (বুখারি, হাদিস : ২৮২৯)।
মহামারীতে মারা যাওয়া ব্যক্তিও শহিদ!!তবুও আচরন এমন কেন? তবুও করোনাকে মহাপাপ ভেবে নেয়া হচ্ছে কেন?এভাবে ঘৃণার চোখে দেখছে কেন মানুষ?
অথচ এগুলোর পরিবর্তে আমাদের সহানুভূতিশীল হওয়া উচিৎ!!
সুতরাং আমাদের উচিৎ সকলের সাথে ভালো আচরন করা এবং মহামারীতে আক্রান্ত ব্যক্তিকে দূর থেকে সাহায্য করা,এবং সাথে থেকে মনোবল যোগানো।
লেখকঃ মৌ আফরিন (মিম),
ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগ,দ্বিতীয় বর্ষ,
নিউ গভঃ ডিগ্রি কলেজ, রাজশাহী।
Well written