বাঙ্গালীদের মধ্যে সেই আদিকাল থেকে কেমন যেন একটা ছোটলোকি ভাব চলে এসেছে। এখন পর্যন্ত সেই অভ্যেসগুলোকে পরিত্যাগ করাতো সহস্র আলোক বর্ষ দূরের কথা এখনও ভুলতে পর্যন্ত পারিনি। গোড়ামি এবং কপটতার যে একটি পরিধি রয়েছে তা আমাদের জানা নেই।
বাঙ্গালি জাতি প্রকৃত শিক্ষা থেকে এখনো অনেক দূরে রয়েছে। আমি মনে করি এদেশের মানুষকে একটি বিবেক বুদ্ধি এবং রুচিশীল চিন্তাচেতনা শিক্ষা দেবার জন্য আলাদা স্কুল এবং কলেজ তৈরী করতে হবে। যেখানে শুধু আমাদের দেশের জনসংখ্যাকে কিভাবে চলনে বলনে সভ্য করে তোলা যায় সেই বিষয়টি সম্পর্কে পাঠদান করা হবে।
আমি বলছি না যে এদেশের মানুষ শিক্ষিত নয়। অবশ্যই শিক্ষিত। কিন্তু সমস্যা হলো অন্য জায়গায়, এদের মাঝে শিক্ষা নেই!
হয়তো অনেকেই এর জোর প্রতিবাদ জানিয়ে বলতে পারেন, ‘ব্যাটা শিক্ষা নেই তাহলে দশ থেকে পনেরো বছর যে আমাদের ছেলেমেয়েরা পড়াশুনা করে সার্টিফিকেট অর্জন করলো সেগুলো বহন করতেও তো মুটে ভাড়া করতে হয়। এটা কি ডাহা মিথ্যে?’
তার উত্তরে আমি সেই আগের কথাটির পুনরাবৃত্তিই করবো, ‘আমাদের রয়েছে সার্টিফিকেটধারী আধুনিক জনগোষ্ঠী, পুথিগত বিদ্যা বহনকারী ভারবাহী জড়বস্তু। এদের চামড়ায় না আছে অনুভূতি শক্তি।
এরা কয়েকটি কাজ খুব ভালোমতোই করতে পারে সেগুলো হচ্ছে, কারো পিছু লেগে থেকে অন্যের ছিদ্র অন্বেষণ করা এবং কেউ উপরে উঠতে চাইলে তাকে পা ধরে নিচে নামানো।
বিশ্বাস করুন এসব ছাড়া এদেশের মানুষের আলাদা কোন যোগ্যতা নেই।
ও হ্যাঁ, আরেকটি যোগ্যতা রয়েছে। কোন এক লেখক রসিকতা করে বলেছিলেন, ‘আমাদের দেশে আপেল গাছ জন্মে না বলে বিজ্ঞানি নিউটনেরও জন্ম হয় না। কিন্তু এদেশে শীতকালে প্রচুর সরিষা গাছ জন্মানোর কারণে দেশের আনাচে-কানাচে তেলবাজ জন্মায়। এরা কুকুরের মতো হাড্ডি চাটা। তেল মালিশ করায় পারদর্শী যে জাতি সে জাতির ভাগ্য এবং রুচির পরিবর্তন কিভাবে হবে বুঝে আসে না। তেল মর্দনে বেশ সুযোগ সুবিধা পাওয়া যায় বলে তারা বড্ড অলসও বটে।
এজন্য হয়তো রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মজাচ্ছলেই বলেছিলেন, ‘তৈল ঢালা স্নিগ্ধ তনু নিদ্রা রসে ভরা।’
দূর্ভাগা জাতিকে নিয়ে অনেক মজার মজার গল্প প্রচলিত রয়েছে লোকমুখে, সেগুলো না হয় অন্য একদিন সময় পেলে বলবো।
আজকে না হয় রসিক বাঙ্গালীকে নিয়ে বাস্তবতা এবং আমাদের চারপাশে ঘটে যাওয়া বিভিন্ন ঘটনা প্রবাহকে কেন্দ্র করে দুয়েকটি কথা বলি।
আমি লেখার মাঝখানে কয়েকটি বিষয় উল্লেখ করেছিলাম তন্মধ্যে, আমাদের দেশের কিছু মানুষের মাঝে ছোটলোকি ভাবটা সেই আদিকাল থেকেই রয়ে গেছে। এবং অপরের ছিদ্র অন্বেষণেও এরা বেশ দক্ষতার পরিচয় দেয়। নিজে যেমন তেমন, অন্যের একটু ভুল হলেই তার চৌদ্দ গোষ্ঠী উদ্ধার করে ছাড়ার মন্দ স্বভাবটা প্রাচীনকালের।
যেহেতু লিখার মাঝখানে বাঙ্গালির ছোট মনের বিষয়টা উঠে এসেছে সেহেতু সেই বিষয়টি নিয়ে একটু আলোচনা করে নেয়া যাক। তার আগে একটি কথা আবার বলতে হচ্ছে এরা কিন্তু মোটেও মার্জিত রুচিবোধ সম্পন্ন জাতি নয়।
শুরু করার আগে একটি প্রশ্ন করে নেয়া ভালো, আপনি যদি একবেলা কারো বাড়িতে পেটপুরে খান তাহলে আর কতদিন খেতে হবে না?
অনেকে হয়তো ধমকের সুরে আমাকে বলতে শুরু করেছেন ব্যাটা প্রশ্নই তো করতে পারিস না, আবার এসেছিস রসিক বাঙ্গালির চরিত্র বিশ্লেষণ করতে!..
তবে উত্তরটা আমি নিজেই বলে দিই, আসলে এই খাবারটা পেটের মাঝে জাস্ট অবশিষ্ট থাকবে পরবর্তী ওয়াস রুমে যাওয়ার আগ পর্যন্তই!
কিন্তু এই বিষয়টাকে আমাদের দেশের কিছু লোক এমনভাবে উপস্থাপন করে বসবেন যেন তারা কয়েক যুগ অনাহারে দিব্বি বেচে রয়েছেন। অন্যের বাড়িতে একবেলা খেতে বসলেই খাবারের নানান দোষ খুঁজতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন তারা। কিন্তু সে মেজবানের দিকটা মোটেও চিন্তা করে দেখার সময় পায় না।
যখন এইচ.এস.সি ফার্স্ট ইয়ারে পড়ি তখন আমার এক কাজিনের বিয়েতে যোগদান করার সৌভাগ্য হয়েছিলো। যথাসময়ে খাবার টেবিলে সবাই মিলে বসলাম। খাবার পরিবেশনা থেকে শুরু করে সবকিছুই ঠিকঠাক ছিলো। কিন্তু সমস্যা হলো যখন আমার এক ভাবী সেখানে খাবারের দোষ বর্ণনা করা শুরু করলেন। এত আনন্দের মাঝেও যে বিষাদের সুর বাজতে পারে সেখানে উপস্থিত না হলে বুঝতে পারতাম না। এর ফলশ্রুতিতে আমরা বর পক্ষ ক্ষেপে গিয়েছিলাম কণে পক্ষের ওপর। যদিও এরপর ঘটনার সুষ্ঠু সমাধান হয়েছিলো বটে।
এই সমস্যাটা নাকি চট্টগ্রামের বিয়েতে একটু বেশি দেখা যায়। বর পক্ষের জন্য রাজ্যের খাবার-দাবারের ব্যবস্থা করতে হয়। কনের বাবা তার সর্বস্ব দিয়ে বর পক্ষের মন যোগাতে চেষ্টা করেন। প্রথম দিকে অবশ্য বিষয়টি আমার নিকট বেশ মজার মনে হয়েছিলে। কিন্তু বর পক্ষ নাকি একজনকে ভাড়া করে নিয়ে আসেন সেই অনুষ্ঠানে ঝামেলা বাঁধানোর জন্য। যার কাজ হচ্ছে কনে পক্ষের একটা ভুল অন্বেষণ করে কাঁচা অানন্দকে পন্ড করা।
যেমনটি আমরা রবীন্দ্রনাথের অপরিচিতা ছোট গল্পে অনুপমের মামার চরিত্রে দেখতে পাই। যিনি সামান্য গহনার জন্য সেই বিয়েটা পন্ড করেছিলেন।
কয়েক মাস আগে বরিশালের বাবুগঞ্জে একটি বিয়ের অনুষ্ঠানে পাতে গোস্তের পরিমান কম দেয়ার কারণে কন্যার পিতাকে বরপক্ষ বুকে আঘাত করে হত্যা করে ফেলে।
একজন বাবা তার মেয়েকে নিজের সমস্তটা দিয়ে মানুষ করেন। বিয়ের সময় আবার বরপক্ষের চৌদ্দ গোষ্ঠী উদ্ধার করার রীতিনীতি। তাতে একটু এদিক-সেদিক হলে মুদ্রার উল্টো পিঠ দেখতে হয়।
আচ্ছা রসিক বাঙ্গালী কি তার জীবনে গোস্ত, পোলাও, কোর্মা, রোস্ট, সালাদ, ডিম, দই, মাছ এগুলো খায়নি?
তাহলে কেন সামান্য একটু খাবারের জন্য যুদ্ধে লিপ্ত হতে হবে!….
কারো বাড়িতে কি কেউ শুধু খাবার খাওয়ার জন্যই যায়? প্রশ্ন রইলো বাঙ্গালি জাতির প্রতি।
আমি যদি কোনদিন কোথাও দাওয়াত খেতে যাই তাহলে প্রথমে বাসা থেকে খেয়ে রওনা হই। আমি কেন অন্যের বাড়ির খাবারের ওপর নির্ভরশীল হব! বিষয়টি আমার আত্ম-সম্মানে বাধে। কেন কোথাও একবেলা খেতে যাওয়ার আগে সারাদিন উপোস থাকতে হবে!…..
সবথেকে মারাত্বক যে দিকটি সেটি হলো খওয়া শেষে নানান দোষত্রুটি খুঁজে বের করে ঢালাওভাবে বলে বেড়ানো।
এতো গেলো খাবারের দিকটা। এটা না হয় মানলাম। অপরদিকে চলনে-বলনে এদের কোন ভ্রুক্ষেপ নেই, কখন কোথায় কিভাবে চলতে হয় বলতে হয় এটাও যেন শিখিয়ে দিতে হবে।
কোন কাজেই ডিসিপ্লিন মেনে চলবে না। একটি কাজ কখনো সুশৃঙ্খলতার সাথে করবে তো দূরের কথা বরং সুযোগ পেলে বিবাদ বাধিয়ে চলে আসার বদ অভ্যেসটা কাজে লাগায়।
এই যেমন ধরুন কোন কাজের জন্য অনেক লোকসমাগম হয়েছে সেখানে লাইনে দাড়াতে বল্লেন কিন্তু রসিক বাঙ্গালী লাইনে না দাঁড়িয়ে বদ অভ্যাস মত বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করবে।
আবার রাস্তাঘাট পার হতে খুব একটা দেখবেন না তাঁরা ফুটওভার ব্রিজ ব্যবহার করছে।
যত্রতত্র পানির বোতল, প্লাস্টিকের মোড়ক, কলার খোসা ফেলে পরিবেশ নষ্ট করে ফেলতে এরা বেশ জানে। কিন্তু বিবেক বুদ্ধির বালাই নেই।
অন্যকে ঠকিয়ে, কাওকে বিপদে ফেলে নিজেদের কার্য হাছিল করা থেকে শুরু করে এমন কোন নিকৃষ্ট কাজ নেই এরা করতে জানে না।
এজন্যই হয়তোবা আমরা সেই অন্ধকারেই পরে রয়েছি। অপর দিকে ভদ্র-সভ্য দেশগুলোর দিকে তাকিয়ে দেখুন, তারা যেমন বিবেকবান তেমনি অর্থনীতিতেও সমৃদ্ধ একেকটি জাতি। তাদের থেকে শিক্ষা নেয়া আমাদের জন্য অপরিহার্য।
ব্রিটিশ শাসনের যেমন নেগেটিভ দিক রয়েছে, তেমনি পজেটিভ দিকও কম নয়। আমাদেরকে হয়তো ব্রিটিশরা কিছুটা চলন-বলন শিখাতে সক্ষম হয়েছিলো। তারা কিন্তু আমাদের ওপর অত্যাচার অনাচার করে সভ্য বানিয়েছিলেন এটা কিন্তু ঢের সত্য কথা।
বহুকাল আগে থেকেই ব্রিটিশরা সভ্য জাতি হিসেবে পরিচিত। সেই সুবাদে তারা যেহেতু আমাদেরকে শাসন শোষণ দুটোই করেছে এজন্য তাদের দুয়েকটি ভাল মন্দ অভ্যাস আমাদের মাঝেও বিস্তার লাভ করেছে।
ব্রিটিশদের নিয়ে কিছু বলে এই লেখাটির কলেবর বৃদ্ধি করতে চাচ্ছি না। যেহেতু ফুট ওভার ব্রিজ নিয়ে একটু আগে কথা বলা শুরু করেছিলাম এজন্য বাঙ্গালির আরো একটি পঁচা স্বভাবের কথা আলোচনা করা যাক।
লেখাটির শুরুতে একটি কথা বলেছিলাম যে, বাঙ্গালিরা অন্যের বিপদ দেখলে মুখের ৩২টা দাঁত বের করেও হাসতে জানে। তারা মত্ত হতে পারে অন্যের বিপদে বিজয় উল্লাসে। ঠিক এই কারণটির জন্য এ জাতির দূর্দশা পিছু ছাড়ছে না।
আপনি রাস্তা-ঘাটে চলতে যাবেন দেখতে পাবেন অসুস্থ প্রতিযোগীতা৷ কে কাকে পেছনে ফেলে এগিয়ে যাবে সেটা নিয়ে চলছে কামড়াকামড়ি। ট্রাফিক আইন ভঙ্গসহ মারাত্বক অপরাধের সাথে এই অসভ্যেরা জড়িত।
ঢাকা শহরেতো এই সমস্যাটি খুব প্রকট। ৫ সেকেন্ড ধৈর্যের পরীক্ষায় অনেকে ফেইল করে আশেপাশের মানুষকে চরম ভোগান্তিতে ফেলছে।
কোন গাড়ি কার আগে যাবে সেই প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়ে নির্লজ্জ বেহায়ার দল মানুষের জীবনকে অতিষ্ঠ এবং হুমকির মুখে ঠেলে দিচ্ছে।
তিতুমীর কলেজের শিক্ষার্থী রাজিবের কথা এখন সবাই ভুলে গিয়েছে। যিনি এই অসুস্থ প্রতিযোগীদের বলির পাঠা হয়ে নিজের হাত হারিয়েছিলেন, শেষ রক্ষা হয়নি তার। অবশেষে মৃত্যুর মুখে ধাবিত হতে হলো তাকে।
পুলিশ জনগনের বন্ধু না হয়ে যখন জনগনের শত্রু হয় তখন জনজীবনে নেমে আসতে পারে কতটা দূর্দশা তা এদেশের মানুষ হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে। সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, ভিক্ষাবৃত্তি সহ কোন কিছু করা বাদ রাখছে না কতিপয় অসভ্য পুলিশ।
মাঝে মাঝে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছবি ভাইরাল হয়, দায়িত্বরত ট্রাফিক পুলিশ হাত বাড়িয়ে দিয়ে টাকা নিচ্ছে গাড়ির ড্রাইভারের কাছে থেকে।
অপরদিকে তাকিয়ে দেখুন। আপনি কোথাও যাচ্ছেন পথে বিপদে পড়েছেন, তখন যাতায়াতের জন্য বাহন ঠিকই পাবেন কিন্তু আপনার কাছে থেকে দুই থেকে তিনগুণ ভাড়া হাতিয়ে নেবে অসাধু চক্র।
সন্ধ্যা হলে ভাড়া বেশি, লোক বেশি হলে ভাড়া বেশি, লোক কম হলেও ভাড়া বেশি। আবার দুই ঈদের সময় ভাড়া বেশি গুনতে হয় যাত্রীদের।
এসব যেন বলার এবং দেখার কেউ নেই।
আবার যখন দেখবেন সিএনজি চালক, ট্রাক চালক, বাস চালক কেউ একজন অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে যাবে ঠিক তখনই ডাক্তারের খেল শুরু, গুনতে হয় মোটা অংকের টাকা। তখন আবার আমরা প্রতিবাদ করি।
কিন্তু আমি বলি ঠিকই আছে। কেননা, যখন ওই ডাক্তার গাড়িতে উঠেছিলো তখন তাকে বিব্রতকর পরিস্থিতির স্বীকার হতে হয়েছিলো ড্রাইভার এবং হেল্পারের কাছে। এখন ওরা ডাক্তারের কাছে জিম্মি হয়ে রয়েছে।
এ যেন রেষারেষির অতল গহ্বরে ডুবে যাওয়া হিংস্র জনগোষ্ঠী।
এভাবে আমাদের জীবন চলছে। প্রতিনিয়ত নির্লজ্জ বাঙ্গালি দেশের মান সন্মান ধুলোয় মিশিয়ে লিপ্ত হচ্ছে বিকৃত আনন্দে। আর চোরের ট্যাগ লাগিয়ে খুব স্বাচ্ছন্দে রাজপথ দাপিয়ে বেড়াচ্ছে বেহায়ার দল।
Leave a Reply