“বাণিজ্য তত্ত্ব, বাণিজ্য নীতি ও বাংলাদেশীদের ভারত ভ্রমণ”
মারক্যান্টাইলিজম হলো সেই তত্ত্ব যা একটি দেশের উচ্চহারে রপ্তানী ও নিম্নহারে আমদানীকে উৎসাহিত করে। উচ্চ রপ্তানীতে দেশ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করে আর আমদানীতে দেশীয় মুদ্রা চলে যায় বিদেশীদের কাছে। পর্যটন শিল্পে ভিন্ন দেশে বেড়াতে গেলে তেমনি মুদ্রা বিদেশে চলে যায়। ‘মেহমান ভগবান সমান’ বলে আমরা যে প্রবাদটি প্রায়ই ব্যবহার করি তার বাস্তব দিক একটি দেশের অর্থপ্রবাহ এবং আয়কে সমৃদ্ধ করে। ভিন্ন দেশের নাগরিক প্রথমে যায় মেহমানদার দেশের এ্যামবেসী, হাইকমিশন কিংবা কনস্যুলেটে ভিসা করতে যার জন্য একটা নির্ধারিত ফি প্রদান করতে হয়। ট্রাভেল টিকিটে ট্যাক্স প্রদান ছাড়াও পোর্ট ট্যাক্স অলক্ষ্যে হলেও দিতে হয়। তারপর সে দেশে নেমে স্থানীয় যানবাহনের ভাড়া, হোটেল ভাড়া, খাবার খরচ, ভ্রমণ সংস্থার চার্জ, বীমা খরচ (যদি থাকে)- সবকিছুতেই কেবল ব্যয় আর ব্যয়। যতদিন একজন পর্যটক কিংবা ভ্রমণকারী দেশটিতে অবস্থান করে প্রত্যেকটি বিষয়ে সে নিজ দেশের অর্থ খরচ করে থাকে। আমাদের দেশ থেকে আমরা ভিন্ন দেশে গেলেও একই ব্যাপার। আর তা শুরু হয় যে দেশে যাই তার এ্যামবেসী থেকেই।
ভারত আমাদের চারদিক থেকে ঘিরে রয়েছে। আমাদের কেনাকাটা (এ্যারোসল থেকে শুরু করে), চিকিৎসা ও তার আনুসাঙ্গিক এবং বেড়ানোকে (পর্যটন) ঘিরে আমরা কী পরিমাণ দেশীয় মুদ্রা ভারতে ব্যয় করি তা হয়ত আমাদের ধারণায় নেই। খবরে দেখলাম কলকাতার মার্কেটগুলোর আশি ভাগ ব্যবসা বন্ধ হয়ে গেছে বাংলাদেশীরা সেখানে শপিংএ যাচ্ছে না বলে (করোনার কারণেই নাকি)। ভারতীয় হাইকমিশনার রীভা গাঙ্গুলি সম্প্রতি এক সাক্ষাতকারে বলেছেন, ২০১৯ সালে ঢাকায় ভারতীয় হাইকমিশন এবং চট্রগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা ও সিলেটের সহকারী হাইকমিশন থেকে ১৬ লাখ ১৯ হাজার ভিসা দেওয়া হয়েছে। এটাই বিশ্বের যেকোনো দেশের ভারতীয় মিশন থেকে ইস্যু করা সর্বোচ্চসংখ্যক ভিসা। প্রতিটা ভিসার ফি যদি সাতশ ৭০০ (সাতশ) টাকা করে হয় (সূত্র: আইভিএসি, ঢাকা) তাহলে এক বছরে ভারতীয় মিশন বাংলাদেশ থেকে কেবল ফি বাবদই আয় করেছে একশ তেরো কোটি তেত্রিশ লক্ষ টাকা। বেড়ানো,চিকিৎসা ও ঔষধ ছাড়াও পেঁয়াজ, রসুন, হলুদ, আদা, মসলা, চিনি, ধানবীজ, কাগজ, ব্লিচিং পাউডার, ভুট্টা, সুতা, ডুপ্লেক্স পেপার, ফ্লাইএ্যাশ ও পাথরের কথা নাহয় বাদই দিলাম।
সব সরকার বাণিজ্যনীতি নির্ধারণে রপ্তানী উৎসাহিতকরণ ও আমদানী বিকল্প পণ্য উৎপাদনে প্রণোদনা প্রদানের নীতি গ্রহণ করে থাকে। তবে পর্যটন শিল্পে (যে উদ্দেশ্যেই হোক) দেশীয় মুদ্রার বিদেশে চলে যাওয়া রোধ করতে এ নীতি কিভাবে প্রযোজ্য হবে তা ভাবনার বিষয়। বাংলাদেশ সরকার ঘোষিত ‘রুপকল্প ভিশন-২০২১’ এ হোটেল-মোটেল ভাড়া নিতে অনলাইন বুকিং ছাড়া আর তেমন কোন উদ্যোগ কার্যকর বলে প্রতিভাত হয় না।
ভারতের সাথে আমাদের বাণিজ্য ঘাটতি সর্বজনবিদিত। তা কমিয়ে আনতে সরকারী নীতির সাথে সহযোগী শিল্পের বিকাশ ও প্রতিষ্ঠা জরুরী। সেটা পর্যটন ছাড়াও অন্য যে কোন শিল্পের জন্যও প্রযোজ্য। মারক্যানটাইলিজম সরকারী নীতি প্রণয়নে যে বিষয়গুলোতে গুরুত্ব দিয়েছে তা কেবল সরকারের জন্যই হয়ত। তবে সরকারী নীতি প্রয়োগের যে মূল নিয়ামক মানুষ; দেশের জনগণ, তারা কোন নীতিতে দেশীয় মুদ্রা দেশের বাইরে ব্যয় করে আসবে সে ব্যাপারে কোন দিক-নির্দেশনা দেয় না। তাই হয়ত এ্যাডাম স্মীথের ‘অদৃশ্য হাত’-এর সাথে তাল রেখে বব থ্যালারের তত্ত্ব (নোবেলপ্রাপ্ত) আমাদের সান্ত্বনা দেয় যে ব্যয়ের দিক থেকে মানুষের আচরণ সবসময়ই অযৌক্তিক। সুতরাং দায়-দায়িত্ব সবই সরকারের।
সরকারের দায়িত্বশীল উদ্যোগই পারে দেশের নাগরিককে দেশের অর্থনীতিতে ব্যয় করতে উৎসাহিত করতে। ব্যক্তি বা অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের বিনিয়োগের চেয়ে প্রতিষ্ঠান হিসেবে সরকারের বিনিয়োগ অনেক বেশি কার্যকর। দেশের মানুষের করের টাকা যেহেতু সরকারের জন্য বড় তহবিল সেই তহবিল নানা ধরনের বিনিয়োগে ব্যয় করলে সরকার সেখান থেকেই আয় করতে পারে। পরিশেষে তার সুবিধা পাবে আপামর জনসাধারণ।
লেখকঃ ড. মুসলিমা জাহান, সহকারী অধ্যাপক, ব্যবস্থাপনা বিভাগ।
প্রাক্তন পরিচালক, এমবিএ এন্ড ইএমবিএ প্রোগ্রাম, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়,ঢাকা।
Leave a Reply